ক্ষতিকারক সিসা থাকায় ১৪ কম্পানির দুধ উৎপাদন বিতরণ ৫ সপ্তাহ বন্ধ
মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদান থাকায় বিএসটিআইয়ের লাইসেন্সধারী ১৪টি কম্পানির পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন ও বিতরণ পাঁচ সপ্তাহের জন্য বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে এ মুহূর্তে বাজারে থাকা দুধ বিক্রি ও কেনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল রবিবার এ আদেশ দেন। আদালত বলেছেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষার প্রতিবেদন এবং মৎস ও পশুখাদ্য আইন-২০১০ অনুসারে বর্তমানে বাজারে থাকা ১৪টি কম্পানির পাস্তুরিত দুধ মানবদেহের জন্য অনিরাপদ ও অগ্রহণযোগ্য।
দুধ নিয়ে গত বছর জারি করা রুলের ওপর শুনানিকালে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে এ আদেশ দেন। আদালত অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনার পাশাপাশি রুলও জারি করেন। এ ছাড়া পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী ২৫ আগস্ট দিন ধার্য করেছেন আদালত। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার কাজী জিনাত হক। বিএসটিআইয়ের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার সরকার এম আর হাসান। রিট আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার অনিক আর হক ও ব্যারিস্টার মো. তানভির আহমেদ। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার ফরিদুল ইসলাম।
অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনায় পাস্তুরিত দুধে অ্যান্টিবায়োটিক, সিসা আছে কি না তা পরীক্ষার সক্ষমতা অর্জন এবং মানসম্পন্ন করতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা জানাতে পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে বিএসটিআইকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
হাইকোর্ট গত ১৪ জুলাই এক আদেশে বাজার থেকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে দুধের নমুনা সংগ্রহ করে তা চারটি পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করতে নির্দেশ দেন। এই নির্দেশ মেনে বাজার থেকে নমুনা সংগ্রহ করে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের ল্যাবরেটরি (সায়েন্স ল্যাব), আইসিডিডিআর.বির ল্যাবরেটরি, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (সাভার) ল্যাবরেটরি এবং জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষার প্রতিবেদন গত ২৩ জুলাই আদালতে দাখিল করা হয়, যা গতকাল উপস্থাপন করা হয়। এই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে গতকাল আদালত আদেশ দেন।
রুলে ১৪টি কম্পানির পাস্তুরিত দুধে মানবশরীরের জন্য ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিক ও সিসার উপস্থিতি কেন সংবিধান ও সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে মানবশরীরের জন্য ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিক ও সিসাসংবলিত দুধ উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও বিপণন করা কেন বেআইনি ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তাদের মানবদেহের জন্য দুধ পরিশুদ্ধ করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সরকারের আটটি সংস্থা এবং ১৪টি দুধ কম্পানিকে দুই সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
আদেশের পর বিএসটিআইয়ের আইনজীবী ব্যারিস্টার সরকার এম আর হাসান সাংবাদিকদের বলেন, আদালতের এই আদেশের পর আজ থেকে বাজারে থাকা পাস্তুরিত দুধ বেচাকেনা করা যাবে না। আদালতের প্রতি সম্মান দেখিয়ে বাজারে থাকা দুধ প্রত্যাহার করে নেবে সংশ্লিষ্ট কম্পানি। আর তারা যদি তা না নেয় তবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘পাস্তুরিত দুধে অ্যান্টিবায়োটিক, সিসা, ডিটারজেন্ট, ফরমালিন, ব্যাকটেরিয়াসহ ক্ষতিকর বিভিন্ন উপাদান মেলে। গত বছর ২১ মে এ বিষয়ে রুল জারি করা হয়। আমরা আশা করেছিলাম, এই রুল জারির পর দুধ উৎপাদনকারী ও সংশ্লিষ্ট তদারকি প্রতিষ্ঠান দুধ পরিশুদ্ধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিষয়টি মনিটর করবে, দুধ পরীক্ষার উদ্যোগ নেবে। কিন্তু তারা তা করেনি। তাই আদালতের আদেশ দেওয়ার প্রয়োজন হলো।’ আদালত বলেন, ‘আমাদের নির্দেশের পর চারটি ল্যাবে দুধের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের ল্যাবরেটরি এবং আণবিক শক্তি কমিশনের পরীক্ষায় দুধে ভেজাল ও দূষণ পাওয়া গেছে। এই প্রতিবেদন আমাদের নজরে এসেছে। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী দুধে অ্যান্টিবায়োটিক (অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, টেট্রাসাইক্লিন ও সিপ্রোফ্লক্সাসিন) এবং সিসার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে; যা জনস্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগজনক।’
আদালত বলেন, ব্যারিস্টার অনিক আর হক আদালতকে দেখান যে মৎস্য ও পশুখাদ্য আইন-২০১০-এর ১৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, (১) মৎস্যখাদ্য ও পশুখাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিক, গ্রোথ হরমোন, স্টেরয়েড ও কীটনাশকসহ অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা যাবে না। কেউ এটা করলে তা আইনগতভাবে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু বাজারে থাকা দুধে অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে। কিন্তু বিএসটিআইয়ের আইনজীবী বলছেন, অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে, যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নয়। কিন্তু আইন অনুযায়ী দুধে কোনোভাবেই অ্যান্টিবায়োটিক থাকতে পারবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
পাস্তুরিত দুধ নিয়ে আইসিডিডিআরবির দেওয়া গবেষণার ফল নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. তানভীর আহমেদ। এই রিট আবেদনে গত বছর ২১ মে এক আদেশে বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের নিয়ে কমিটি গঠন করে বাজারে থাকা পাস্তুরিত দুধ পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দিতে খাদ্য ও স্বাস্থ্যসচিব এবং বিএসটিআইয়ের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এরই ধারাবাহিকতায় আদালতের আদেশে চারটি ল্যাবে দুধের নমুনা পরীক্ষা করা হয়।
যে ১৪টি কম্পানির দুধ উৎপাদন বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে:
১. আফতাব মিল্ক অ্যান্ড মিল্ক প্রডাক্ট লিমিটেডের ‘আফতাব’ ব্র্যান্ড
২. আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের ‘ফার্মফ্রেশ মিল্ক’ ব্র্যান্ড
৩. আমেরিকান ডেইরি লিমিটেডের ‘মো’ ব্র্যান্ড
৪. বাংলাদেশ মিল্ক প্রডিউসার’স কো-অপারেটিভ ইউনিয়ন লিমিটেডের ‘মিল্ক ভিটা’ ব্র্যান্ড
৫. বারো আউলিয়া ডেইরি মিল্ক অ্যান্ড ফুডস লিমিটেডের ‘ডেইরি ফ্রেশ’ ব্র্যান্ড
৬. ব্র্যাক ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রজেক্টের ‘আড়ং ডেইরি’ ব্র্যান্ড
৭. ড্যানিশ ডেইরি ফার্ম লিমিটেডের ‘আয়রান’ ব্র্যান্ড
৮. ইছামতি ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রডাক্টসের ‘পিউরা’ ব্র্যান্ড ৯. ঈগলু ডেইরি লিমিটেডের ‘ঈগলু’ ব্র্যান্ড
১০. প্রাণ ডেইরি লিমিটেডের ‘প্রাণমিল্ক’ ব্র্যান্ড
১১. উত্তরবঙ্গ ডেইরির ‘মিল্ক ফ্রেশ’ ব্র্যান্ড
১২. শিলাইদহ ডেইরির ‘আল্ট্রা’ ব্র্যান্ড
১৩. পূর্ব বাংলা ডেইরি ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের ‘আরওয়া’ ব্র্যান্ড এবং
১৪. তানিয়া ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রডাক্টসের ‘সেইফ’ ব্র্যান্ড।