বকশিশ ছাড়া সেবা মিলছে না পঙ্গুতে, ভোগান্তি চরম পর্যায়ে
রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) রোগীদের ভোগান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। অব্যবস্থাপনা আর দালালদের দৌরাত্ম্যে দূরদূরান্ত থেকে চিকিৎসা নিতে আসা গুরুতর আহত রোগীদের পোহাতে হচ্ছে চরম ভোগান্তি।
হাসপাতালটিতে প্রবেশের সময়ই পড়তে হচ্ছে কর্মচারি ও দালালদের খপ্পরে। প্রধান ফটক থেকে জরুরি বিভাগের ফটক পর্যন্ত দল বেঁধে থাকে দালাল চক্র। রোগীকে উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেয় তারা। তাছাড়া দূত সেবার জন্য দিতে হবে অতিরিক্ত অর্থ বা বকশিশ।
বিশেষ করে যেসব রোগী দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার ২৪ ঘণ্টা পর চিকিৎসা নিতে আসে তাদের ভর্তি করা হয় না হাসপাতালটিতে। এই রোগীরাই থাকে দালালদের মূল টার্গেটে।
হাসপাতালটিতে চিকিৎসাধীন রোগীদের অভিযোগ বকশিশ দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠতে হচ্ছে তাদের। বিশেষ করে জরুরি বিভাগে তাৎক্ষণিক বেড পেতে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা বকশিশ দিতে হয় স্টাফদের। আর তা দিতে না পারলে দুই থেকে তিন দিন জরুরি বিভাগের বাইরে মেঝেতে থাকতে হচ্ছে।
রোগীদের অভিযোগ, ড্রেসিং করার সময়ও বকশিশ না দিলে ভালোভাবে কাজ করে না দায়িত্বরত স্টাফরা। এসব অব্যবস্থাপনার বিষয়ে কর্র্তৃপক্ষের কোনো পদক্ষেপ নেই।
দালালদের দৌরাত্ম্যের কথা স্বীকার করে হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, ‘এই দালালদের বিরুদ্ধে কিছু বলা মুশকিল। এরা বেশিরভাগই স্থানীয় মাস্তান, হাসপাতালের স্টাফদের অনেকেই এদের সঙ্গে জড়িত। এজন্য চিকিৎসকদের এ বিষয়ে কিছু করার থাকে না।’
হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল গণি মোল্লা বলেন, ‘দালালদের দৌরাত্ম্য একেবারে নেই এমন বলা যাবে না, তবে এখন আগের চেয়ে অনেক কম। কর্মচারীদের কেউ কেউ জড়িত থাকতে পারে। এরা সাধারণত গভীর রাতে অবস্থান নেয়। হাসপাতালের পাশের বস্তির মাদকসেবী ও সন্ত্রাসীরা প্রতিনিয়ত বিশৃঙ্খলা করে। হাসপাতালের নিরাপত্তা এদের কারণে ব্যাপকভাবে বিঘিœত হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও সিটি করপোরেশনের মেয়রকে জানানো হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘মূলত হাসপাতালটিতে আসনের তুলনায় রোগী অনেক বেশি হওয়ায় দালালরা সক্রিয় রয়েছে। নতুন ভবন খুলে দেওয়া হলে এবং প্রাচীর তৈরি করতে পারলে এই সমস্যা পুরোপুরি সমাধান করা যাবে। দালালদের সঙ্গে যদি কোনো স্টাফ বা চিকিৎসকের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
টাকার বিনিময়ে জরুরি বিভাগের বেড দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এমন অভিযোগ কেউ করেনি। তবে বেড সংকটের কারণে যদি কোনো স্টাফ এমন কাজ করেন, তবে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হাসপাতালের নতুন ভবনে ৫০০ বেড রয়েছে। কয়েক
দিনের মধ্যেই এখানে রোগী রাখা যাবে। তখন আর রোগীদের ভোগান্তিতে পড়তে হবে না।’
গত মঙ্গল ও বুধবার পঙ্গু হাসপাতালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনে চার-পাঁচজনের জটলা। কোনো অ্যাম্বুলেন্স জরুরি বিভাগের সামনে এসে থামলেই ছুটে দুই-তিনজন এগিয়ে যাচ্ছেন রোগীর কাছে। কী সমস্যা শোনার পরই বলছেন চেম্বারে দেখালে আজই অপারেশন হবে। এই ডাক্তাররাই দেখবেন। কেউ যেতে রাজি হলেই দালালদের একজন তাদের সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালের বাইরে ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যাচ্ছেন। দালালদেরই একজন মো. রিপন। সাংবাদিক পরিচয় গোপন করে ঢাকার বাইরে থেকে একজন পা ভাঙা রোগী নিয়ে এসেছি জানালে তিনি বলেন, ‘এখানে ভালো চিকিৎসা পাবেন না। সময় মতন অপারেশনও করা হবে না। আপনি চেম্বারে ভালো চিকিৎসা পাবেন। প্যাকেজে কাজ করে দেব। খুশি হয়ে যা বকশিশ দেন তাতেই হবে।’
রিপনের মতো আরও অনেকেই এই কাজে যুক্ত রয়েছেন। যারা রাত দিন জরুরি বিভাগের সামনে থাকে।
হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মো. আলী নামের এক আনসার সদস্য বলেন, যারা রোগী ভাগিয়ে নিচ্ছে এদের সবাই চেনে।
জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত নার্সরা বলেন, এখানে সব মিলে ৪৮টি বেড আছে। কিন্তু প্রতিদিন ১১০ থেকে ১২০ জন রোগী ভর্তি করা হয়। ফলে সবাইকে বেড দেওয়া সম্ভব হয় না।
জরুরি বিভাগে কথা হয় মাদারীপুরের শিবচরে অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত রুবেল হোসেনের ছোট ভাই রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, দুর্ঘটনায় রুবেলের ডান পা হাঁটুর নিচে থেকে ভেঙে গেছে। রবিবার রাত ২টার দিকে হাসপাতালে এসেছি। ডাক্তার বলেছে অপারেশন করতে হবে। ওটিতে যাওয়ার সময় এক লোক বলে এখানে ভালো চিকিৎসা হয় না। বাইরে চেম্বারে ডাক্তার ভালো করে দেখবেন। আমি ওই লোকের সঙ্গে সেই চেম্বারেও গিয়েছিলাম। কিন্তু সবার সঙ্গে কথা বলে পরে এখানেই চিকিৎসা নিচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, বেড পাওয়ার জন্য এখানকার এক স্টাফকে ৫০০ টাকা দিতে হয়েছে। আর সুই দেওয়া লোককে ৫০০ দিতে হয়েছে আস্তে সুই ফোটানোর জন্য।
পঙ্গু হাসপাতালের এই দালালদের বিরুদ্ধে সর্বশেষ ২০১৭ সালে ২৭ আগস্ট অভিযান চালায় র্যাব। হাসপাতালের সামনে থেকে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করার দায়ে দালাল চক্রের ৮ সদস্যকে আটক করে শাস্তি দেওয়া হয়।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমরানুল হাসান বলেন, ‘সকল ধরনের অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে র্যাবের অভিযান চলমান রয়েছে। আমাদের জনবল সংকটের জন্য বেশি অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। তবে জন কল্যাণে দ্রুতই পঙ্গু হাসপাতালে দালালদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হবে।’
র্যাব সদর দপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারোয়ার আলম বলেন, ‘পঙ্গু হাসপাতালে অভিযানে গিয়ে দেখা গেছে রোগীদের যে দালালেরা ঠকাচ্ছে তাদের সঙ্গে হাসপাতালের কিছু চিকিৎসক ও স্টাফ জড়িত। কর্র্তৃপক্ষও তাদের চেনে তবে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। ফলে অভিযান চালিয়ে শাস্তি দিয়েও দালালদের ঠেকানো যাচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘কোনো রোগী দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার ২৪ ঘণ্টা পরে পঙ্গু হাসপাতালে আসলে তাকে আর ভর্তি করা হয় না। দালালেরা ওই সকল রোগীদের টার্গেট করে। ওখানকারই কিছু চিকিৎসক হাসপাতালের পাশে প্রাইভেট হাসপাতালে চেম্বার খুলে বসেছে। সেখানে ওই রোগীদের নিয়ে যায় দালালেরা।’