‘পূর্ব পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে আমার ছেলেকে’

আমার ছেলেকে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ছেলেকে তো আর ফিরে পাবো না, প্রশাসনের কাছে অনুরোধ, যাতে করে হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়। আমার কিছু চাওয়ার নাই, আমি সুষ্ঠু বিচার চাই’−ছেলের খুনিদের এভাবেই শাস্তির দাবি জানান বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের বাসিন্দা নিহত রিফাত শরীফের বাবা দুলাল শরীফ।

বুধবার (২৬ জুন) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে নয়ন ও তার সহযোগী সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে রামদা দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে গুরুতর আহত করে রিফাত শরীফকে (২৫)। এরপর অস্ত্র উঁচিয়ে বীরদর্পে এলাকা ত্যাগ করে তারা। গুরুতর অবস্থায় রিফাতকে প্রথমে বরগুনা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং পরে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রিফাত।

রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বলেন, ‘সকালে আমি একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠি। সকাল ৯টায় আমার ফোনে তিনবার রিং বাজলেও আমি টের পাই নাই। সকাল ১০টার পরে আমি ঘুম থেকে উঠছি। রিফাতের চাচা শ্বশুরের ফোন পেয়ে হতবিহ্বল হয়ে যাই। তড়িঘড়ি করে একটা মোটরসাইকেল নিয়ে হাসপাতালে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি অ্যাম্বুলেন্স তাকে (রিফাত) নিয়ে বরিশালের উদ্দেশে রওনা হচ্ছে। আমি দরজা খোলার পর বাবার চেহারাটা দেখার পর মনে করছি আল্লাহ জানি কী…।’ এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

নৃশংস হত্যার শিকার রিফাতের বাবা বলেন, ‘তারপর বলি আমি যেতে পারবো না। আমার যেহেতু হার্টের সমস্যা, ডাক্তার আমাকে নিষেধ করেছেন জানাজায় পর্যন্ত না যেতে, মৃত্যু সংবাদও যেন আমাকে কেউ না বলে। তাই আমি রয়ে গেছি। ওই অবস্থায় তাকে হাসপাতাল (বরিশালে) নিয়ে গেছে। এর পরের ঘটনা তো সবাই জানে।’

দুলাল শরীফ আরও বলেন, ‘হাসপাতালে যাওয়ার পর লোকমুখে শুনেছি ওরা (হামলাকারীরা) ওখানে পূর্বপরিকল্পিতভাবে ওঁৎ পেতে ছিল। তা না হলে তাদের হাতে রাম দা কেন থাকবে? আমি মনে করি, তারা জানতো সে কলেজে যাবে।’

ছেলের হত্যার বিচারের দাবি জানিয়ে দুলাল শরীফ বলেন, ‘আমার একটাই আশা, এ ধরনের সন্ত্রাসী যারা আছে, তাদের বিচার হওয়া উচিত। হত্যাকাণ্ডে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। আমার কিছু চাওয়ার নাই। আমার সন্তান চলে গেছে, সে তো আর ফিরে আসবে না। আমি সুষ্ঠু বিচার চাই। প্রশাসনের কাছে এটাই আমার দাবি।’

হত্যাকাণ্ডে কারা জড়িত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিকেবি রোডের নয়ন নামে একটা ছেলে জড়িত। এলাকায় সে একজন কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী। সে একবার হেরোইন, একবার ফেনসিডিল নিয়ে ধরা পড়েছে। জেল খেটেছে। এসপি সাহেবের কাছে নালিশ করার পর তিনি একবার ধরে চালান দিছেন। কিন্তু পরে বের হয়ে যায়। সন্ত্রাসীরা কখনও জেলে আটকা থাকে না। তাদের নেটওয়ার্ক খুব বড় থাকে। ওপরে তাদের অবশ্যই বড় ধরনের লিংক আছে, যারা তাদের বের করে আনে। বরগুনাতে মাদক ব্যবসায়ী যারা আছে তারা ঢুকে (জেলে) আর বের হয়। আমি এই জিনিসটাই বুঝি না। ঢুকলেই কেমনে বের হয়ে যায়। প্রশাসনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, তারা যেন এটা খতিয়ে দেখেন। এছাড়া, রিফাত ফরাজিসহ আরও দুই-তিনজন জড়িত আছে।’

দুলাল শরীফ বলেন, রিফাত সকালে বাসা থেকে ৫০০ টাকা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছিল। সে বলেছিল স্ত্রীকে নিয়ে কলেজে যাবে। কিন্তু কখনও বুঝতে পারিনি এই যাওয়াই ওর শেষ যাওয়া হবে।’

এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, আয়শা আক্তার মিন্নির সঙ্গে দুই মাস আগে রিফাত শরীফের বিয়ে হয়। বুধবার (২৬ জুন) রিফাত ও তার স্ত্রী মিন্নি সকাল ১০টার দিকে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ওঁৎ পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা রামদা নিয়ে রিফাতের ওপর চড়াও হয়।এ সময় মিন্নি তাদের বাধা দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। কিন্তু, তার বাধা সত্ত্বেও সন্ত্রাসীরা রিফাতকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। হাতে থাকা একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ দিয়ে বারবার আত্মরক্ষার চেষ্টা চালান রিফাত। কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না। সন্ত্রাসীরা তার হাত-পা, বুক, পিঠসহ সারাশরীর কুপিয়ে রক্তাক্ত করে।

ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, মিন্নি এ সময় একবার সন্ত্রাসী নয়নকে, আরেকবার নয়নের সহযোগী দুর্বৃত্ত রিফাত ফরাজীকে আটকানোর চেষ্টা করেন এবং ‘বাঁচাও, বাঁচাও, না না বলে চিৎকার করতে থাকেন। কিন্তু, ততক্ষণে রামদার কোপে মারাত্মক আহত হন রিফাত। এরপর তাকে উদ্ধার করে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে বিকালে রিফাত শরীফ মারা যান।