দল ভাঙনের আশঙ্কা নিয়ে বৈঠকে বসছেন ঐক্যফ্রন্ট নেতারা!
দূরত্ব ঘুচিয়ে ও ‘ভুল বোঝাবুঝি’ নিরসন করে ফের রাজপথে সক্রিয় হচ্ছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে বৈঠকে বসছেন ফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা। আজ জেএসসি সভাপতি আ স ম আবদুর রবের উত্তরার বাসায় মিলিত হবেন তারা। এর আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বৈঠক বর্জন করেছিলো বিএনপি। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে অনৈক্যের বিষয়টি জানান দিয়েছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তবে আজকের এ বৈঠকে ড. কামাল হোসেন, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কাদের সিদ্দিকী, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরীসহ ফ্রন্টের শীর্ষ নেতাদের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক নেতা জানিয়েছেন, আজকের বৈঠকে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে জোটের শরিকদের মধ্যে নানা ইস্যুতে সৃষ্ট সংকট, দূরত্ব এবং ভুল বোঝাবুঝি দূর করার উদ্যোগ নেয়া হবে।আলোচনা হবে রাজপথে নামার নতুন কর্মসূচির বিষয়েও।
৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে যাত্রা শুরু করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। একসঙ্গে আন্দোলন, নির্বাচন এবং সরকার গঠনের লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামা জোটটি নির্বাচনে আটটি আসনে জয়লাভ করে।
নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ এনে ফল বর্জন ও সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ঐক্যফ্রন্ট। জোট শরিকদের না জানিয়ে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে বিএনপি ও গণফোরামের নির্বাচিত এমপিরা শপথ নেন। এ নিয়ে ফ্রন্টের শরিকদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এসব কারণে পুনর্নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েও শেষ পর্যন্ত আর মাঠে দেখা যায়নি তাদের।
জোট সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে কোনো কর্মসূচি না থাকা এবং বিএনপি ও গণফোরামের সদস্যদের সংসদে যোগদান নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ভেতরে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।
পাশাপাশি বগুড়া-৬ আসনের উপনির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ এবং জোটের আরেক শরিক দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর জোট ছাড়ার আলটিমেটামের মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অসন্তোষ প্রকাশ্যে আসে। ফলে কার্যত থমকে দাঁড়ায় জোটের যাবতীয় কর্মকাণ্ড।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ভরাডুবির পর বিভিন্ন মহল থেকে মন্তব্য করা হয়, এ জোটে জামায়াত থাকায় তাদের শোচনীয় পরাজয় হয়েছে। জামায়াতকে জড়িয়ে ড. কামাল হোসেনেরও সমালোচনা করে কোন কোন মহল। এমন পরিস্থিতিতে ১২ জানুয়ারি রাজধানীর মতিঝিলে গণফোরামের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য করে ভুল হয়েছে বলে মন্তব্য করে। এ দলের সঙ্গে আর রাজনীতি করবেন না বলে জানান গণফোরাম সভাপতি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন।
তিনি বলেন, জামায়াতের সঙ্গে কখনও রাজনীতি করিনি, ভবিষ্যতেও করব না।
এক প্রশ্নের জবাবে ড. কামাল বলেন, আমি যখন ঐক্যে সম্মতি দিয়েছি তখন জামায়াতের কথা আমার জানা ছিল না। এটা ঐক্যফ্রন্ট গঠনে ভুল ছিল। এছাড়া তড়িঘড়ি ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে যেসব ভুলত্রুটি হয়েছে তা সংশোধন করা হবে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, জামায়াতের ২২ প্রার্থীকে ধানের শীষ প্রতীক দেয়ার বিষয়টি আমি জানতাম না। দেয়ার পর বিএনপির কাছে আমি ব্যাখ্যা চেয়েছিলাম। তারা বলেছেন, সবাই ধানের শীষের প্রার্থী এখানে জামায়াতের কেউ নেই।
বিএনপিকে জামায়াত ছেড়ে আসতে চাপ সৃষ্টি করা হবে কিনা সে বিষয়ে ড. কামাল হোসেন বলেন, আমি তো মনে করি, জামায়াত ছেড়ে আসতে বিএনপিকে চাপ দেয়া যেতে পারে। বিএনপির সঙ্গে জামায়াত থাকলে ভবিষ্যতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থাকবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, জামায়াত নিয়ে কোন রাজনীতি নয়, অবিলম্বে এ বিষয়ে সুরাহা চাই।
সংবাদ সম্মেলন করে জোটে জামায়াত থাকা প্রসঙ্গে ড. কামাল হোসেনের বক্তব্যের পর জামায়াত নেতারা বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। এর ফলে ড. কামাল হোসেনের বক্তব্যকে সহজভাবে নিতে পারেনি বিএনপি হাইকমান্ডও। তাই বিএনপি নেতারাও ড. কামাল হোসেনের ওপর ক্ষুব্ধ হয়। এ পরিস্থিতিতে কয়েকদিন ধরে উভয়ের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করলেও বৃহস্পতিবার ড. কামাল হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠক বর্জন করে তাদের দলীয় অবস্থান পরিষ্কার করে বিএনপি।
জানা গেছে, এই অচলাবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দীর্ঘদিন পর বৈঠকে বসছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা। এর আগে তারা ঘরোয়াভাবে কয়েক দফা বসেছেন, কথাও বলেছেন নিজেদের মধ্যে। প্রথমে ১২ জুন বৈঠক ডাকা হলেও পরে তা এগিয়ে ১০ জুন নির্ধারণ করা হয়।
ঈদের পর দিন এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে ফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন জানান, ঐক্যফ্রন্ট ভাঙছে না, জোটের পরিধি আরও বাড়বে। পাশাপাশি রাজপথে সক্রিয় হওয়ার ঘোষণা দেন ড. কামাল হোসেন।
সেই প্রস্তুতি হিসেবে আজকের বৈঠক বলে জানিয়েছেন জোট সংশ্লিষ্ট নেতাদের কেউ কেউ। এতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বিগত দিনের কার্যক্রম পর্যালোচনা ও পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা হবে।
জানা গেছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ঐক্য ধরে রাখতে বিএনপির আন্তরিকতার কমতি নেই। এ বিষয়ে ড. কামাল হোসেনও ইতিবাচক। ঈদের পর দিন দলের নেতাকর্মীরা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি ঐক্যের ওপর জোর দিয়ে আগামী দিনের আন্দোলন সংগঠিত করার আহ্বান জানান। ডিসেম্বরের মধ্যে ফল আনতেও তাগাদা দেন ড. কামাল হোসেন। এর অংশ হিসেবেই অভ্যন্তরীণ সংকট দূর করে নিজেদের ঐক্য সুসংহত করার পাশাপাশি নয়া উদ্যমে রাজপথে নামার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।
বৈঠক হলেই ঐক্যফ্রন্টের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে মনে করছে জোটের শরিক দলগুলো। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আজকের বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন। প্রশ্ন উঠলে তিনি উত্তর দেবেন— এ প্রস্তুতি তার রয়েছে।
ঐক্যফ্রন্টের শরিক নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ঐক্যফ্রন্ট কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে, বিষয়টি ঐক্যফ্রন্টের বড় দল হিসেবে সবচেয়ে বেশি নির্ভর করছে বিএনপির ওপর। পাঁচ মাস নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকলাম, সে নিষ্ক্রিয়তা ভাঙতে পারে বিএনপি। তারা কোনো কারণেই হোক উদ্যোগ নিচ্ছে না। আশা করি, বিএনপি দ্রুত এগিয়ে আসবে।