ঘূর্ণিঝড় ফণীর তাণ্ডবে দক্ষিঞ্চালের ৬ জেলার ৩০ গ্রাম প্লাবিত

ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে গতকাল শুক্রবার দুপুর থেকে বরিশালসহ দক্ষিণের ছয় জেলায় ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এতে বাঁধ ভেঙে পটুয়াখালীর কলাপাড়া, রাঙ্গাবালী ও পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার কমপক্ষে ৩০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

পটুয়াখালী ও বরগুনার উপকূলবর্তী কলাপাড়া, পাথরঘাটা ও তালতলী এবং মঠবাড়িয়া উপজেলার বলেশ্বর তীরবর্তী বাসিন্দারা ঝুঁকি এড়াতে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যান। দুপুরে ঝড়ে কলাপাড়ার ডাবলুগঞ্জে গাছ পড়ে আহত হয়েছেন তিনজন। দক্ষিণের ৬ জেলায় সব ধরনের নৌযান চলাচল গত বৃহস্পতিবার থেকেই বন্ধ রয়েছে। এ ৬ জেলায় এক হাজার ৬৮০টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হলেও পটুয়াখালী, বরগুনা ও পিরোজপুরের উপকূলবর্তী উপজেলাগুলোর বাসিন্দারা তাদের গবাদিপশু নিয়ে মহাদুশ্চিন্তায় পড়েছেন।

ফণীর প্রভাবে ভোলায় গতকাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কয়েক দফা বৃষ্টি ও মাঝারি ঝড়ো বাতাস বয়ে গেছে। সন্ধ্যার আগেই জেলার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যান ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার প্রায় ৪০ হাজার বাসিন্দা। তবে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে উত্তাল মেঘনায় মাছ ধরতে দেখা গেছে কিছু জেলেকে। এ ছাড়া সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ দ্বীপের প্রায় ২০ লাখ মানুষ দেশের অন্যান্য এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

বরিশাল, বরগুনা, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বাউফল, ভোলা ও চরফ্যাসন :বরিশালে গতকাল দুপুর ২টায় মাঝারি ঝড়বৃষ্টি হয়েছে। বরিশাল আবহাওয়া অফিসের উচ্চ পর্যবেক্ষক মিলন মিয়া বলেন, ঘূর্ণিঝড় ফণী পায়রা বন্দর থেকে ৫৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছে।’ গতকালও দু’দফায় প্রস্তুতিমূলক বৈঠক করেছেন জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়ার রহমান। জেলার সর্বত্র মাইকিং করে জনগণকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হচ্ছে। গতকালও বরিশাল থেকে অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার লঞ্চ চলাচল বন্ধ ছিল। বরিশাল বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক রথীন্দ্রনাথ চৌধুরী গতকাল দুপুরে জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বরিশাল বিমানবন্দর থেকে গতকাল ফ্লাইট চলাচল অব্যাহত ছিল।

বরগুনায় গতকাল দুপুর ১টার পর শুরু হয় ঝড়বৃষ্টি। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, বিষখালী ও বলেশ্বর নদের পানি গত দু’দিনের চেয়ে ৩৬ সেন্টিমিটার বেড়েছে। সদর উপজেলার সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ নলটোনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হুমায়ন কবির জানান, নাজুক বাঁধের কারণে ইউনিয়নের বাসিন্দারা মহাঝুঁকিতে আছেন। সদর উপজেলার নিশানবাড়িয়া গ্রামের গাজী মাহমুদ প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রসহ বিষখালী তীরবর্তী আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে গতকাল দুপুর থেকে আশ্রয় নিতে শুরু করে লোকজন। পাথরঘাটায় দুপুর সাড়ে ১২টায় ৮-১০ মিনিট উচ্চগতির ঝড় বয়ে যায়। এরপর থেকেই বলেশ্বর নদ ও সাগর তীরবর্তী হরিণবাড়িয়া, হাজীরখাল, লাঠিমারা, চরদোয়ানী ও গাববাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দাসহ বিষখালী তীরবর্তী পৌর শহরের বাসিন্দারা যে যার মতো ছুটছেন আশ্রয়কেন্দ্রের উদ্দেশে। চরদোয়ানী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন ফিরোজ জানান, গোটা ইউনিয়নের বাসিন্দারা যানমাল নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে গেলেও গবাদিপশুগুলোকে বেঁধে না রেখে ছেড়ে দিয়েছেন। মানুষ গবাদিপশু কোথায় রাখবেন, তা নিয়ে বিপদে আছেন। পাথরঘাটার ভারপ্রাপ্ত ইউএনও জাকির হোসেন জানান, উপজেলার ২০৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে গতকাল বিকেল পর্যন্ত প্রায় অর্ধলাখ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।

পিরোজপুরের সাত উপজেলার বিভিন্ন সাইক্লোন শেল্টারে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। মঠবাড়িয়া উপজেলার সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ সাপলেজা, আমড়াগাছিয়া, বেতমোড় ও তুষখালী ইউনিয়নের বাসিন্দারা গতকাল দুপুরের পর থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া শুরু করে। বলেশ্বরের পানি বাড়ায় সাপলেজা ইউনিয়নের খাতাচিড়া, কচুবাড়িয়াসহ ৪-৫টি গ্রাম ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে। সাপলেজা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার আফজাল হোসেন বেপারী জানান, খাতাচিড়ায় আধাকিলোমিটার, বাবুরহাট থেকে বলেশ্বরহাট পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। এসব এলাকার ৬০০ পরিবার ব্যাপক ঝুঁকির মধ্যে আছে। দুপুরের পর থেকে তারা হাজিগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পূর্ব খাতাচিড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে।

মঠবাড়িয়ার ইউএনও জিএম সরফরাত জানান, বলেশ্বরের মাঝেরচরের সহস্রাধিক মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসা হয়েছে।

পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটাসহ পটুয়াখালীর সাগর তীরবর্তী কলাপাড়া উপজেলায় গতকাল দুপুরে প্রচণ্ড গতির ঝড় বয়ে যায়। এতে ডাবলুগঞ্জ ইউনিয়নের জাহাঙ্গীর সিকদার, হাফিজ মুসল্লি ও সূর্য বেগম নামে তিনজন গাছ পড়ে গুরুতর আহত হয়েছেন।

লালুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শওকত হোসেন বিশ্বাস জানান, ভাঙা বাঁধ দিয়ে রামনাবাদ নদের পানি ঢুকে ১৬ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কুয়াকাটা-সংলগ্ন সাগর তীরবর্তী ধুলাসার ইউনিয়নের খাজুরা, নিজামপুর, গঙ্গামতি ও লতাচাপলী ইউনিয়নের বাসিন্দারা আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছে।

বাঁধ না থাকায় পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নের গরুভাঙ্গা, গোলবুনিয়া, বিধিরহাওলা, মধ্য চালিতাবুনিয়া ও উত্তর চালিতাবুনিয়া এবং চরমোন্তাজ ইউনিয়নের ৪টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইউএনও মাশফাকুর রহমান। চরমোন্তাজের চেয়ারম্যান হানিফ মিয়া ও চালিতাবুনিয়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান জানান, এ দুই ইউনিয়নের বাসিন্দাদের পালিত গরু-মহিষসহ হাজার হাজার গবাদিপশুর ভাগ্য অনিশ্চয়তায় পড়েছে। বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে মির্জাগঞ্জ উপজেলার মেহেন্দিয়াবাদ, চরখালী ও গোলখালী, সদর উপজেলার মাটিভাঙ্গা, ভাজনা, ফুলতলাসহ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

গতকাল দুপুরের দিকে রাঙ্গাবালীর চরকাশেম দ্বীপের ঝুঁকিতে বসবাসরত দুই শতাধিক পরিবারকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। এছাড়াও জেলার উপকূলীয় উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চলের লোকজনকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত থেকে পর্যটকদের সরে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং দফায় দফায় মাইকিং করা হচ্ছে।

এদিকে এবার বাউফলের তেঁতুলিয়াপাড়ের সাধারণ মানুষকে ফণীর আগাম সতর্কবার্তা দেয়নি নাজিরপুরের ধানদি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের উপরে স্থাপিত পলফিটেড মেগাফোন সাইরেন। সেটি বন্ধ রয়েছে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে।

ফণীর প্রভাবে ভোলায় গতকাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কয়েক দফা বৃষ্টি ও মাঝারি ঝড়ো বাতাস বয়ে গেছে। গতকাল সকালে ভোলা ইলিশা ফেরিঘাটে শত শত যাত্রী লক্ষ্মীপুর রুটে যাওয়ার জন্য এলেও কোনো নৌযান না চলায় তারা বিপাকে পড়েন। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিক বলেন, ৮৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৩৬ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।

চরফ্যাসনে ফণীর প্রভাবে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। শুক্রবার দুপুরে ঢালচর ও চরপাতিলা, মুজিবনগর ইউনিয়নের সিকদারচরের বিস্তীর্ণ নিচু এলাকা তলিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া উপজেলার ২১টি ইউনিয়নের সাড়ে ৬ লাখ মানুষের জন্য পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নেই। কুকরীমুকরী ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ-সংলগ্ন বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন জানান, ঢালচর ইউনিয়ন ও চরপাতিলায় বেড়িবাঁধ না থাকায় অতিজোয়ারে এসব এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।