স্বপ্নের নগরীর স্বপ্ন পূরণের আগেই বিদায় নিলেন সপ্নবাজ!

আজ ৩০ নভেম্বর, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রথম নির্বাচিত মেয়র আনিসুল হকের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৭ সালের এই দিনে লন্ডনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। উপলক্ষে তার পরিবারের পক্ষ থেকে বিশেষ দোয়া ও খাবার বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া আজ বাদ আসর গুলশান আজাদ মসজিদে বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠিত হবে।

২৮ নভেম্বর বুধবার তার গড়া প্রতিষ্ঠান মোহাম্মদী গ্রুপে বাদ আসর মিলাদ ও দোয়া, ২৯ নভেম্বর বৃহস্পতিবার বাদ জোহর তার চেম্বারে কোরআনখানি অনুষ্ঠিত হয়। মরহুম আনিসুল হক ছিলেন একাধারে ব্যবসায়ী, সংগঠক ও সেলিব্রিটি। হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগ থেকে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র পদে তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়। এরপর রাজধানীকে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। কিন্তু দায়িত্ব নেয়ার মাত্র দুই বছর পরেই মারা যান তিনি।

২০১৭ সালের ২৯ জুলাই ব্যক্তিগত সফরে সপরিবারে লন্ডনে যান আনিসুল হক। সেখানে তিনি সেরিব্রাল ভাসকুলাইটিসে (মস্তিষ্কের রক্তনালির প্রদাহ) আক্রান্ত হন। ১৩ আগস্ট তাকে সেখানকার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ২৩ মিনিটে লন্ডনের ওয়েলিংটন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান স্বপ্নবাজ এই মেয়র।

মৃত্যুর আগে যেটুকু সময় হাতে পেয়েছিলেন তারই মধ্যে বহু উন্নয়ন কাজ শুরু করেছিলেন, উচ্ছেদ করেছিলেন রাস্তা, ফুটপাথ, পার্কসহ বিভিন্ন অবৈধ দখল। আনিসুল হক ২০১৫ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ডিএনসিসির মেয়র নির্বাচিত হন। রাজধানীকে পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ ও ‘স্মার্ট’ নগরী হিসেবে গড়ে তোলার বেশকিছু উদ্যোগ নিয়ে আলোচিত ও প্রশংসিত হন তিনি। তার দৃঢ় পদক্ষেপেই রাজধানী থেকে অপসারিত হয়েছিল অবৈধ বিলবোর্ড, ব্যনার-ফেস্টুন। রাজধানীকে ঘিরে নানা স্বপ্ন ছিল তার। শুরুও করেছিলেন সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন, তবে অকাল মৃত্যুর কারণে শেষ করে যেতে পারেননি।

২০১৫ সালের ডিসেম্বরে তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনালের সামনের সড়ক দখলমুক্ত করতে গিয়ে বিক্ষুব্ধ চালকদের ক্ষোভের মুখে পড়েন তিনি। পরে তার নেতৃত্বে ডিএনসিসি ওই সড়ক দখলমুক্ত করে। এ ঘটনায় তিনি রাতারাতি দেশজুড়ে জনপ্রিয়তা পান।

এছাড়া নগরবাসীর কাছে ঢাকার আকাশ একরকম অবরুদ্ধ হয়েই ছিল। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার এক বছরের মধ্যেই তিনি ঢাকা শহর থেকে সব বিলবোর্ড উচ্ছেদ করেন, যা সাধারণ নগরবাসীর কাছে ছিল অবিশ্বাস্য।

শ্যামলী থেকে গাবতলী পর্যন্ত বিভিন্ন পরিবহনের যানবাহনে রাস্তা দখল ছিল। ফলে দীর্ঘসময় যানজটে মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হতো। প্রতিশ্র“তি মোতাবেক ঘোষণা দিয়েই তিনি শ্যামলী থেকে গাবতলী পর্যন্ত রাস্তা গতিময় করে তোলেন।

বিভিন্ন এলাকার পার্কগুলো দখলদারদের কাছে চলে গিয়েছিল। আনিসুল হক একের পর এক সেসব পার্ক দখলদারদের কাছ থেকে উদ্ধার করেন। শহরের পথচারীদের জন্য আধুনিক টয়লেট নির্মাণ করেন। এজন্য মানুষের আস্থার জায়গা তৈরি হয় আনিসুল হককে ঘিরে।

গুলশান, বনানী, বারিধারা ও নিকেতন এলাকায় বিশেষ রঙের রিকশা এবং ‘ঢাকা চাকা’ নামে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস সেবা চালু করেন আনিসুল হক। বিমানবন্দর সড়কে যানজট কমাতে মহাখালী থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সড়কে ইউলুপ করার উদ্যোগ নেন আনিসুল হক।

এছাড়াও ঢাকার খালগুলো উদ্ধারে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন আনিসুল হক। তার নির্দেশে বনানীর ২৭ নম্বরে যুদ্ধাপরাধী মোনায়েম খানের বাড়ি ‘বাগ এ মোনয়েম’র অবৈধ দখলে থাকা অংশ উদ্ধার করে সড়ক প্রশস্ত করা হয়।

প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আনিসুল হকের পরিবারের পক্ষ থেকে তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া এবং খাবার বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে বাদ আসর গুলশান আজাদ মসজিদে বিশেষ দোয়া।

আনিসুল হকের জন্ম নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে ১৯৫২ সালে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (সম্মান) ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। আশির দশকে টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘আনন্দমেলা’ ও ‘অন্তরালে’ নামে দুটি অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করতেন। আনিসুল হক একজন সফল ব্যবসায়ীও। ১৯৮৬ সালে তার নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘মোহাম্মদী গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠা করেন। মোহাম্মদী গ্রুপের চেয়ারম্যান আনিসুল হকের তৈরি পোশাক ছাড়াও বিদ্যুৎ, তথ্যপ্রযুক্তি, আবাসন, কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানা রয়েছে। ডিজিযাদু ব্রডব্যান্ড লিমিটেড ও নাগরিক টেলিভিশনের মালিকানাও তার ব্যবসায়ী গ্রুপের।

২০০৫ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিজিএমইএ’র সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সার্ক চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বিআইপিপিএ’রও সভাপতি ছিলেন।