আর কত সাথির প্রাণ গেলে ফিরবে মানুষের বিবেক?
মেয়েটির নাম সাথী। বয়স সবেমাত্র আট নয় বছর। অতি দরিদ্র পরিবারে জন্ম তার। বাবা মা ঠিকমত তিন বেলা খাবার দিতে পারেনা বলেই মেয়েটি একটু ভাল থাকবে এই আশায় ঢাকা শহরে কাজল রেখার বাসায় মাসিক ২,০০০/= ( দুই হাজার ) টাকা বেতনে গৃহপরিচারিকার কাজ দেন।
কিন্তু সাথির ঢাকায় আসাটা হয়ে যায় হিতে বিপরীত। একটু পান থেকে চুন খসলেই তার উপর চলত অমানুষিক নির্যাতন। তীব্র নির্যাতনে মাঝে মাঝে সে বেহুশ হয়ে পড়ত। সর্বশেষ গত ২৩/০৫/২০১৮ তারিখ রাতে খেতে বসে ভাতে চুল পায় কাজল রেখা। সাথিকে চুলের মুটি ধরে সজোরে ধাক্কা মারে ওয়ালের সাথে। অসহায় সাথির মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। আবার আরেক ধাক্কা। সাথি ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে। গৃহকর্ত্রী কাজল মনে করল সাথি ভান ধরছে। এরপর ছুরি ও স্টিলের স্কেল দিয়ে তার সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। একটি চোখ উপড়ে ফেলে। এক পর্যায়ে সাথি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বড় একটি হাড়ীতে সাথির লাশ ভরে রাখে। ঘরের রক্তাক্ত মেঝে ও ওয়াল সারারাত ধরে নিজে পরিষ্কার করে।
ভোর হল। এবার লাশ গুম করার পালা। বাজারে গিয়ে একটি ট্রলি বেগ ও রং কিনে আনে। সাথির ঘাড় মটকিয়ে ও হাত পা ভেঙে অনেক কষ্টে ট্রলিবেগে ভরে। নিরুপায় হয়ে কাজল রেখা বিষয়টি তার নেশাগ্রস্ত মামা শফিকুলের সাথে শেয়ার করে। পরে দুজনে প্লান করে লাশটি শফিকুল রিকশায় করে আব্দুল্লাহপুর শ্যামলী বাস কাউন্টারে যাত্রী-বেশে রেখে আসবে। শফিকুল রিকশায় উঠে ট্রলিবেগ নিয়ে রওয়ানা হয় কিন্তু পথিমধ্যে পড়ে যায় দাক্ষিনখান থানা পুলিশের চেকপোস্ট। চেকপোস্টে কর্তব্যরত এস আই মেহেদী হাসানের সন্দেহ হয় ট্রলিবেগ দেখে। রিকশা থামাতে বলার সাথে সাথে শফিকুল দৌড় দেয়; সাথে পুলিশও। আটক হয় শফিকুল। বেরিয়ে আসে খুনি কাজল রেখার লোমহর্ষক কাহিনী।
এবার কাজল রেখাকে ধরার পালা। মামা শফিকুল কে নিয়ে যাই কাজলের বাসায় কিন্তু তালাবন্ধ। পরে আটক করা হয় কাজলের মাকে। তবে তারা কেউ কাজলের অবস্থান ও খুন সম্পর্কে তথ্য দেয়না। এর মধ্যে পেয়ে যাই কাজলের মোবাইল নম্বর ও ছবি। প্রযুক্তির সহায়তায় তার অবস্থান পাই টঙ্গীতে। সাথে সাথে আমি, ওসি দক্ষিনখান তপন চন্দ্র সাহা ও ইন্সপেক্টর অপারেশন নুর মোহাম্মদ সহ একটি টিম রওয়ানা হই টঙ্গীর উদ্দেশ্যে। আমরা যাওয়ার আগেই সে আবার চলে যায় গাজীপুর চৌরাস্তা হয়ে মাওনা। আমরাও পিছু নিলাম। কিন্তু কাজল বড়ই চালাক। সে আবার মাওনা হতে চলে আসে রাজেন্দ্রপুর। রাজেন্দ্রপুর নেমে উঠে কিশোরগঞ্জের বাসে। এরমধ্যে ইফতার এর সময় হয়ে গেল টেরই পেলামনা। ইফতার সেরে নিয়ে আবার রওয়ানা হলাম কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে। জানিনা সে কোন বাসে উঠেছে। এরমধ্যে তথ্য পেলাম সে কিশোরগঞ্জের ঘাইটাল বাস স্ট্যান্ডে নামবে। আমরাও অপেক্ষা করতে থাকি। হঠাৎ দেখি একটি বাস হতে বোরকা পরিহিত এক ভদ্র মহিলা নেমে ফ্লেক্সি লোডের দোকানে গিয়ে ফোনে কথা বলছেন। আমরা কাছে গিয়ে ‘কাজল রেখা’ বলে ডাকতেই সে চমকে উঠে এবং বলে উঠে স্যার আমি কিন্তু সাথিকে মারিনি। অবশেষে আটক খুনি কাজল রেখা। সে ভাবতেই পারেনি এত দ্রুত গ্রেফতার হবে, মাত্র ১০ ঘণ্টায় এবং অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে “সার আপনারা কেমনে বুঝতে পারলেন আমি কিশোরগঞ্জে আসছি? টঙ্গী পার হওয়ার পর আমি পরানে পানি পাইছিলাম যে এইবার আর ধরে কে? আমিতো আমার মোবাইল ও বন্ধ করে দিয়েছিলাম!”
রাত তখন ১২ টা। কাজল রেখাকে আটকের পর অন্যরকম প্রশান্তি অনুভব করলাম। পরে ভোর ৪ টায় আমরা ঢাকায় পোছাই। সাথির দরিদ্র পিতার বুকফাটা আর্তনাদ এখনো কানে বাজে। আনন্দের বিষয়, আজকে খুনি কাজল রেখা ও তার মা আদালতে তাদের দোষ স্বীকার করে ঘটনার লোমহর্ষক জবানবন্দি দিয়েছে। সাথি হত্যার বিচার নিশ্চিত করার জন্য আমরা আমাদের সামর্থ্যের সবটুকু উজাড় করে কাজ করেছি। সাথি তুমি শান্তিতে ঘুমাও।
লেখক: মিজানুর রহমান সহকারী কমিশনার দক্ষিণখান থানা জোন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ঢাকা