ময়না তদন্তের পরও ভেদ হল না মৃত্যুর রহস্যের! 

ঢাকার মিরপুরে এক নারী ও তার দুই শিশু সন্তানের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় পুলিশ মায়ের আত্মহত্যার সন্দেহের কথা বললেও ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক বলেছেন, আঘাতের ধরনগুলো তার কাছে ‘ব্যতিক্রমধর্মী’ বলে মনে হয়েছে। “আঘাতগুলো একটু অন্য ধরনেরই। সাধারণভাবে আমরা যে ধরনের পাই, তার চেয়ে একটু ব্যতিক্রমধর্মী বটে।” মঙ্গলবার মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষে সংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. এএম সেলিম রেজা।

ঢাকার মিরপুর পাইকপাড়ায় সরকারি কলোনির একটি বাসা থেকে সোমবার রাতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মী জেসমিন আক্তার (৩৫) এবং তার দুই সন্তান হাফিদা তাসলিম হিমি (৯) ও আবিলা তাহমিম হানির (৬) রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনজনের লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে যুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, জেসমিনের গলার পাশাপাশি দুই হাতে কবজির কাছে কাটা ছিল। বুকে ছিল অন্তত বারোটি আঘাতের চিহ্ন। বড় মেয়ে হিমির পেটে তিনটি আঘাতের চিহ্ন এবং বাঁ হাতের কবজির কাছে কাটা ছিল। ছোট মেয়ে হানির পেটে একটি এবং ডান হাতের কবজির কাছে কাটা ছিল। দুজনেরই গলা ছিল কাটা। জেসমিন মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন- এমন তথ্য পাওয়ায় এবং ঘটনাস্থলের আলামত দেখে পুলিশ কর্মকর্তারা রাতে বলেছিলেন, দুই মেয়েকে গলা কেটে হত্যার পর জেসমিন আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন বলে প্রাথমিকভাবে তারা ধারণা করছেন।

এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক এএম সেলিম রেজা বলেন, তিনজনের মৃত্যুর সঠিক কারণ কী- তা সব পরীক্ষা শেষ হলে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তারা জানাতে পারবেন। তিনি জানান, তিনজনকে বিষ খাওয়ানো হয়েছিল কি না- তা জানতে পুলিশের অনুরোধে তারা ভিসেরা সংরক্ষণ করেছেন। আঘাতের ধরন ‘ব্যতিক্রমধর্মী’ বলে আসলে কী বোঝাতে চাইছেন- এমন প্রশ্নে এই চিকিৎসক বলেন, “সাধারণত এরকম ক্ষেত্রে একটি আঘাত থাকে। এখানে বেশ কতগুলো আঘাত সারা শরীরে রয়েছে, এমনকি বাচ্চাগুলোরও।”

জেসমিনের স্বামী হাসিবুল ইসলাম চাকরি করেন সংসদ সচিবালয়ে। তিনি পুলিশকে বলেছেন, সোমবার কর্মস্থল থেকে বাসায় ফিরে তিনি শোবার ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ পান। পরে ডাকাডাকি করে সাড়া না পেয়ে দরজা ভেঙে ঢুকে তিনজনের মৃতদেহ দেখতে পান।”ওই পরিবারের সদস্যদের বরাত দিয়ে ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপ কমিশনার মাসুদ আহমেদ বলেন, মাইগ্রেনের সমস্যার কারণে আর মায়ের মৃত্যুর পর জেসমিন হতাশায় ভুগছিলেন। ২৫ দিন আগে তিনি মেয়েদের অতিরিক্ত ঘুমের বড়ি খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। পরে পরিবারের সদস্যরা টের পেয়ে এক মেয়েকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলে।

তবে জেসমিন সন্তানদের মেরে নিজে আত্মহত্যা করে থাকতে পারে- পুলিশের এমন ধারণা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন তার ছোট ভাই শাহীনুর ইসলাম। সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “একাই কীভাবে সম্ভব যে নিজের দুইটা হাত কেটে আবার পেটে গলায় কেটেছে? ভাগনী দুজনেরই হাত কাটা গলা কাটা। বিষয়টা বুঝতে পারছি না। আপা নিজে করেছে, না অন্য কিছু?” এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, দরজা ভেঙে যে ঘর থেকে তিনজনের লাশ উদ্ধার কার হয়েছে, সেই ঘরে বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগানোর  সুযোগ নেই। আবার ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে বাইরে বের হওয়ারও সুযোগ নেই।

শাহীন আরও বলেন, মাইগ্রেনের জন্য ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নিয়েছিলেন জেসমিন। ফেরার পর পুরোপুরি সুস্থ থাকলেও তার ঘুম বেশি হত। দুপুরে অফিস থেকে ফিরে মেয়েদের নিয়ে তিনি নিজের ঘরে শুয়ে পড়েছিলেন। তখন বাসায় ছিলেন শাহীন আর তাদের এক মামাতো বোন। জেসমিনের স্বামী হাসিবুল ছিলেন অফিসে। বোন ফেরার পর শাহীন নিজেও একটি কাজে বাইরে চলে যান বলে সাংবাদিকদের জানান। তিনি বলেন, সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফেরার পর তিনি জেসমিনের ঘরের দরজা ভেতর থেকে লাগানো দেখেন। তবে আগে কখনও বোনকে তিনি দরজা ভেতর থেকে আটকে ঘুমাতে দেখেননি।

“আমি আসার আগে দুলাভাই একবার দরজা ধাক্কা দিয়েছিল। কিন্তু না খোলায় মনে করেছিল, ঘুমাচ্ছে যখন বিরক্ত করার দরকার নেই। পরে মাগরিবের সময় উনি মসজিদে চলে যান। ”শাহীন বলেন, সন্ধ্যার পর অনেক ধাক্কাধাক্কি করেও সাড়া না পেয়ে তাদের সন্দেহ হয়। হাসিবুল নামাজ শেষে ফিরলে দরজা ভাঙার চেষ্টা করা হয়। এক পর্যায়ে দরজা কিছুটা ফাঁক করে সেখান দিয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় বড় মেয়েকে দেখেন হাসিবুল। তখন রড দিয়ে দরজা ভেঙে তিনজনকে মৃত অবস্থায় পান তারা।

দারুস সালাম থানার ওসি সেলিমুজ্জামান বলেন, এ ঘটনায় মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত কেউ থানায় মামলা করেনি। তবে পুলিশ ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে। তিনি বলেন, “ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আসার পরই জানা যাবে আসলে কীভাবে তাদের মৃত্যু হয়েছে। আমরা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করছি।”

ময়নাতদন্ত শেষে জেসমিন আর তার দুই সন্তানের মরদেহ পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় গ্রামের বাড়িতে তাদের দাফন করা হবে বলে জানান শাহীন।