‘গণহত্যা দিবস ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মাহুতির প্রতি জাতির চিরন্তন শ্রদ্ধার স্মারক’
আজ ২৫শে মার্চ। ভয়াল কাল রাত এবং জাতীয় গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঢাকায় ঘটেছিলো মানব সভ্যতার ইতিহাসে কলঙ্কিত হত্যাকাণ্ড। সেই বছরের এই রাতে বর্বর পাক বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে স্বাধীনতাকামী বাঙালির ওপর হিংস্র দানবের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আর এদিন বাঙ্গালি জাতি তথা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছিল ইতিহাসের এক নৃশংস বর্বরতা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালন প্রকৃতার্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মাহুতির প্রতি জাতির চিরন্তন শ্রদ্ধার স্মারক এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস উপলক্ষে দেয়া এক বাণীতে একথা বলেন।
গণহত্যা দিবসে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধা জানান এবং জাতীয় চার নেতাকে স্মরণ করেন। এছাড়াও তিনি শ্রদ্ধা জানান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ নির্যাতিতা মা-বোনকে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদের প্রতি জানান সমবেদনা। সেই সঙ্গে সব শহীদের রুহের মাগফেরাত কামনা করেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধসমূহ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ প্রণয়ন করেছিলেন। সেই আইনের আওতায় অনেকের বিচার সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দেয় এবং বিচার কাজ বন্ধ করে দেয়। শুধু তাই নয়, চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অংশীদার করে।
খালেদা জিয়াও স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে গণহত্যার দোসর নিজামী-মুজাহিদদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেয়। এখনও তাদের সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করছে বলে বাণীতে উল্লেখ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য পরিচালনা করছি, বিচারের রায় কার্যকর করা হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত থাকবে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের ব্যাপারে আমরা সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।
১৯৪৭ সালের দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তনিরা বাঙালিদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ শুরু করে। অর্থনৈতিক শোষণ ছাড়াও তারা আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানে। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ নেয়। পাকিস্তানিদের এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম রুখে দাঁড়ান উল্লেখ করে তিনি বলেন, তার নেতৃত্বে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের সংগ্রাম। বাঙালিদের ওপর নেমে আসে অত্যাচার এবং নির্যাতন। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ৬-দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান এবং ৭০’র সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ের পথ ধরে বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম যৌক্তিক পরিণতির দিকে ধাবিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগরতলা মামলা দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু বাঙালিরা দমবার পাত্র নন। তারা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে আনেন। আইয়ুব খানের পতন হয়। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেয়।
ইতিহাস তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঢাকাসহ দেশের প্রধান প্রধান শহর ও বন্দরে হত্যা করা হয় হাজার হাজার নিরীহ মানুষ। সেই রাত থেকে পরবর্তী নয় মাস পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর-রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর সদস্যরা-সারা দেশে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালায়। হত্যা করে প্রায় ৩০ লাখ মানুষকে। এত কম সময় ও স্বল্প পরিসরে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ হত্যার নজির বিশ্বে আর নেই। শুধু মানুষ হত্যা নয়, একইসঙ্গে দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করা হয়। লাখ লাখ বাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট করা হয়। বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত করা হয় প্রায় এক কোটি মানুষকে।
গ্রেফতারের পূর্বমুহূর্তে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন জানিয়ে তিনি বলেন, তৎকালীন ইপিআর ওয়ারলেসসহ, টেলিপ্রিন্টার-টেলিগ্রাফের মাধ্যমে এ ঘোষণা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালি জাতি ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে।
১৯৭১ সালের ১৩ জুন সানডে টাইমস পত্রিকায় অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ‘জেনোসাইড’ শিরোনামে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সে সময় ঢাকায় মার্কিন কনসাল জেনারেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন আর্চার ব্লাড। তিনি যেসব টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরে সেখানে বাংলাদেশের ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ বা ‘নির্বাচিত গণহত্যা’ হিসেবে উল্লেখ করেন। গিনিস বুক অব রেকর্ডে বাংলাদেশের ১৯৭১ এর হত্যাযজ্ঞকে বিংশ শতাব্দীর ৫টি গণহত্যার মধ্যে অন্যতম গণহত্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয় বলে বাণীতে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি গণহত্যা দিবস উপলক্ষে গৃহীত সব কর্মসূচির সাফল্য কামনা করেন।