এবার নাফ নদের ওপারে মিয়ানমারের সেনা টহল

বিজিবির অভিনব এক পদক্ষেপ গ্রহণের পর বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্ত থেকে সেনাসদস্যদের সরানোর পর এবার কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তের ওপারে নাফ নদের তীরবর্তী এলাকা জুড়ে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) ইউনিফর্মের আড়ালে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করেছে মিয়ানমার।

রবিবার সন্ধ্যা থেকে রাখাইন রাজ্যের মংডু এলাকার এক নম্বর সেক্টর থেকে সীমান্ত জুড়েই অতিরিক্তি সেনা মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা।

টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা আবদুল মতলব জানান, তুমব্রু সীমান্তে অতিরিক্তি সেনা ও ভারী অস্ত্রের সমাবেশ ঘটানোর পর এবার টেকনাফের নাফ নদের তীরে সীমান্তে সেনা মোতায়েন করেছে মিয়ানমার।

অনুপ্রবেশকারীদের বরাত দিয়ে তিনি আরও জানান, সেনাবাহিনী বড় বড় গাড়ি নিয়ে রাত-দিন টহল দিচ্ছে।

সেনাবাহিনীর সাবরাং হারিয়াখালী ত্রাণ কেন্দ্রে দায়িত্বরত জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি ও টেকনাফ উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন জানান,সোমবার টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের হারিয়াখালী সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে চার পরিবারের ১৩ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছেন।

তিনি আরও জানান, গত কয়েকদিন ধরে এই পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ থাকলেও আবারও আসতে শুরু করেছে। যেসব রোহিঙ্গা ঢুকে পড়েছে, তাদের মানবিক সহতায় দিয়ে নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে।

সদ্য অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা জানান, ‘রবিবার সন্ধ্যায় ৪০-৫০ জনের একটি দল বাংলাদেশে পালিয়ে আসার জন্য মংডুর হাসসুরাতা এলাকায় রওনা দেয়। পথে তারা দেখতে পান সেনাবাহিনীর সারি সারি গাড়ি টহল দিচ্ছে। পরে দলটি এলোমেলো হয়ে যায়। তারমধ্যে ১০ জনের মতো একটি দল মিয়ানমার সীমান্তে পৌঁছায়। এরপর তারা নৌকায় নাফ নদ পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েন। বাকিরা কে কোথায় আছে জানা নেই’।

এদিকে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রবিউল হাসান জানান, নাফ নদীর ওপারের সীমান্তে মিয়ানমারের সেনা মোতায়েনের খবর সংবাদকর্মীদের কাছ থেকে শুনেছি। বিষয়টি খতিয়ে দেখে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।

প্রসঙ্গত, এর আগে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে গত বৃহস্পতিবার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ সেনা সমাবেশ ঘটায়। এ নিয়ে উত্তেজনা দেখা দিলে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পক্ষ থেকে পতাকা বৈঠকের আহ্বান জানানো হয়। পরদিন (শুক্রবার) বিকেলে ঘুমধুম সীমান্তের মৈত্রী সেতু এলাকায় বিজিবি এবং বিজিপির মধ্যে দেড় ঘণ্টা পতাকা বৈঠক হয়। এরপর সীমান্তে উত্তেজনা কিছুটা কমে আসে। কিন্তু তার একদিন পর রবিবার আবারও তুমব্রু সীমান্তে সেনা মোতায়েন করে মিয়ানমার।

এরপর সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য তুমব্রু সীমান্তে জিরোলাইনে তিনটি ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা লাগানোর পর থেকেই পিছু হটে যায় মিয়ানমারের সেনারা।

বিষয়টি নিশ্চিত করে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) কক্সবাজারের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবদুল খালেক জানান, সীমান্তে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য তুমব্রুতে তিনটি সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। ঠিক কৌশল নয়, এটি প্রশিক্ষিত বাহিনীর আধুনিক প্রযুক্তির একটি ব্যবহার। সীমান্ত সুরক্ষায় বিজিবি সর্বদা সতর্ক প্রহরায় রয়েছে। নতুন করে সীমান্তে কোনো জনবল বৃদ্ধি করা হয়নি।

তিনি আরো বলেন, পতাকা বৈঠকে মিয়ানমার জানিয়েছে, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রয়োজনে সীমান্তে সেনা-বিজিপির টহল বাড়িয়েছে তারা (মিয়ানমার)। তাই সার্বিক সীমান্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য বিজিবির পক্ষ থেকে সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়। ক্যামেরায় দেখা গেছে, সীমান্ত থেকে সেনা সরিয়ে নিয়েছে মিয়ানমার।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, গত বুধবার থেকে দফায় দফায় তুমব্রু সীমান্তে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেনা-বিজিপির সংখ্যা বাড়ায় মিয়ানমার। শূন্যরেখায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে মাইকিং, ফাঁকা গুলি ছোড়া, মদের বোতল ও গুলতি মেরে ভয়ভীতি দেখিয়ে নো ম্যানস ল্যান্ড থেকে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা চালায় মিয়ানমারের সেনা-বিজিপি। কিন্তু সীমান্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য বিজিবি তুমব্রু সীমান্তে সিসি ক্যামেরা লাগানোর পর থেকেই পিছু হটে মিয়ানমারের সেনারা।

এমনকি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে টহলও কমায় সেনা-বিজিপি। তবে সীমান্ত এলাকায় আজ সকাল থেকেই মিয়ানমারের সেনাদের দেখা যাচ্ছে না। অতিরিক্ত কোনো বিজিপি সদস্য চোখে পড়ছে না।

গত বুধবার থেকে সীমান্তের তুমব্রু পয়েন্টে দফায় দফায় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেনা-বিজিবির সংখ্যা বাড়ায় মিয়ানমার। সীমান্ত সড়কের পাশে পাহাড়ের চূড়াগুলোতে বাঙ্কার স্থাপন করা হয়। বাঙ্কার থেকে শূন্যরেখার  আশ্রয় ক্যাম্প তাক করে রাখা হয়েছিল অস্ত্র।

শূন্যরেখায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা জানান, তুমব্রু সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার কাছ থেকে গতকাল রবিবার সন্ধ্যার পর থেকে মিয়ানমারের কোনো সেনা দেখা যাচ্ছে না। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে টহলের সংখ্যাও কমেছে আগের তুলনায়। কিন্তু গত রাতেও শূন্যরেখা থেকে রোহিঙ্গাদের চলে যেতে মাইকিং করেছে বিজিপি। বর্তমানে পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক ভালো। অনেকটা স্বস্তিতে আছেন রোহিঙ্গারাও।