পুরান ঢাকার দোল উৎসব!

হিন্দু সমপ্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব দোল পূর্ণিমা আজ। বাংলাদেশে এ উৎসবটি ‘দোলযাত্রা’, ‘দোলপূর্ণিমা’ নামে পরিচিত। দোলযাত্রা হিন্দু বৈষ্ণবদের উৎসব।

মানুষের মনে কত রঙ যদি দেখতে চান তাহলে দোল পুর্নিমায় যেতে হবে পুরান ঢাকায়। একে অপরকে রঙ মাখিয়ে পালন করা হয় এই উৎসব। যাকে বলে দোল খেলা বা হোলি খেলা। পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার, শাঁখারী বাজার এবং লক্ষ্মীবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় জাকজমকভাবে এই উৎসব পালিত হয়েছে।

দিনের প্রথম ভাগে রং দিয়ে ভরিয়ে ফেলা হয় সব এলাকা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রায় সবাই একে অন্যের গায়ে রঙ মেখে চেহারাই বদলে ফেলেন। শুধু পুরান ঢাকা নয় সারা দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এইদিনে রঙ খেলার উৎসবে মাতেন।

আত্মীয় এবং প্রতিবেশীরা একে অন্যের বাড়িতে গিয়ে রং দিয়ে আসে। এই রং খেলার সময়ে তাঁতীবাজার এবং শাঁখারী বাজার এলাকাতে কোন সাধারণ মানুষ ঢুকলে সেটা অনায়াসে অনুমান করা যায় কারণ সেই ব্যক্তির কোথাও না কোথাও রং লেগে থাকবে। এ সময় এ এলাকায় ঢুকলে উপর থেকে, পাশ থেকে, আপনার অগোচোরে পিছন থেকে ছুটে আসা রঙের ফোয়ারা থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই।

পুরান ঢাকার দোল উৎসব!

রঙ ছড়ানো হোলিতে পাড়ার ছেলেরা বালতি ভর্তি করে রং নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ বড় বড় সিরিঞ্জে করে রং দেয় কেউ বেলুনে ভরে এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে রং ছুড়ে মারে। আর এই উৎসবের দাগ সবার গায়ে লেগে থাকবে প্রায় সপ্তাহব্যাপী।

খ্রিস্ট জন্মেরও কয়েক শ’ বছর আগে থেকে হোলি উদযাপন করা হতো বলে জানা যায়। ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের প্রাচীন আরিয়ান জাতির কাছ থেকে এই উৎসবের জন্ম বলে ধারণা করা হয়। এই উৎসবের নমুনা পাওয়া যায় খ্রিস্ট জন্মেরও প্রায় ৩০০ বছর আগের পাথরে খোদই করা একটি ভাস্কর্যে। তাছাড়া এই উৎসবের উল্লেখ রয়েছে হিন্দু পবিত্র গ্রন্থ বেদ এবং পুরানেও।

৭০০ শতকে দিকে রাজা হর্ষবর্ধনের সময়ে সংস্কৃত ভাষায় লেখা একটি প্রেমের নাটিকাতেও হোলি উৎসবের বর্ণনা রয়েছে। পরে বিভিন্ন মন্দিরের গায়ে খোদাই করা চিত্রকর্মে হোলি খেলার নমুনা বিভিন্নভাবে ফুটে ওঠে।

ইংরেজরা প্রথম দিকে এই উৎসবকে রোমান উৎসব ‘ল্যুপেরক্যালিয়া’ হিসেবেই মনে করেছিল। অনেকে আবার একে গ্রীকদের উৎসব ‘ব্যাকানালিয়া’-এর সঙ্গেও তুলনা করত। কিন্তু এ ছিল একেবারেই এক দেশি উৎসব – প্রাণের উৎসব, আনন্দের উৎসব।

প্রাচীন ভারতে এই ঋতুতে যে উৎসবটি অনুষ্ঠিত হত তাকে ইতিহাসে ‘মদনোৎসব’ হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। খ্রীস্টীয় তৃতীয়-চতুর্থ শতক থেকে আরম্ভ করে ষোড়শ শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতের সর্বত্র যে এ উৎসবের প্রচলন ছিল, তা সেকালের নানা গ্রন্থে উল্লেখিত আছে।

বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’ যা রচিত হয়েছিল তৃতীয়-চতুর্থ শতকে, তাতে এই উৎসবের উল্লেখ আছে। সপ্তম শতকে রচিত শ্রীকৃষ্ণের ‘রত্নাবলী’ এবং অষ্টম শতকের ‘মালতী-মাধব’ নাটকেও এর বর্ননা পাওয়া যায়।

জীমূতবাহনের ‘কালবিবেক’ ও ষোড়শ শতকের ‘রঘুনন্দন’ গ্রন্থেও এই উৎসবের অস্তিত্ব ঘোষিত হয়েছে। ‘হোলি’ ছিল কিন্তু ফাল্গুনের উৎসব। আর্যরা সম্ভবত এটি পেয়েছিল অনার্য উৎস থেকে। ফাল্গুনের শুক্লা চর্তুদশীতে ও পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত হত ‘হোলি’। ‘হোলাক’ বা ‘হোলক’ নাম থেকে এসেছে এ উৎসবের নাম। সুশস্য উৎপাদনের প্রার্থনায় সৃষ্টি হয়েছিল এই উৎসব। বাঁশের গায়ে খড় চাপিয়ে জ্বালানো হত ‘অজন্মা’ দৈত্যের খড়। উত্তর ভারতে বলা হত হিরণ্যকশিপুর ভগিনী ‘হোলিকার’ বিনাশ করেছিল ভক্ত প্রহ্লাদ। তাই এই অগ্নির প্রয়োগ।

দোলযাত্রা একটি হিন্দু বৈষ্ণব উৎসব। এই উৎসবের অপর নাম বসন্তোৎসব। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দোলযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী, ফাল্গুনী পূর্ণিমা বা দোলপূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির ও গুলাল নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপীগণের সহিত রং খেলায় মেতেছিলেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি হয়।

দোলযাত্রার দিন সকালে তাই রাধা ও কৃষ্ণের বিগ্রহ আবির ও গুলালে স্নাত করে দোলায় চড়িয়ে কীর্তনগান সহকারে শোভাযাত্রায় বের করা হয়। এরপর ভক্তেরা আবির ও গুলাল নিয়ে পরস্পর রং খেলেন। দোল উৎসবের অনুষঙ্গে ফাল্গুনী পূর্ণিমাকে দোলপূর্ণিমা বলা হয়। আবার এই পূর্ণিমা তিথিতেই চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম বলে একে গৌরপূর্ণিমা নামেও অভিহিত করা হয়।

দোলযাত্রা উৎসবের একটি ধর্মনিরপেক্ষ দিকও রয়েছে। এই দিন সকাল থেকেই নারীপুরুষ নির্বিশেষে আবির, গুলাল ও বিভিন্ন প্রকার রং নিয়ে খেলায় মত্ত হয়। হোলি খেলা এতটাই মজার যে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মাতে এ উৎসবে।

কোথাও কোথাও বসন্তের পূর্ণ আগমনীকে স্বাগত জানানো হয় এই উৎসবের মাধ্যমে। তাই গাছে গাছে নতুন পাতা এবং নতুন ফুলকে স্বাগত জানানো হয় ভরা পূর্ণিমায় পুরনো কাঠ এবং পাতাকে পুড়িয়ে ফেলে সেই গাছ এবং পাতা পোড়া ছাই শরীরে মাখিয়ে নেয়।

পুরান ঢাকার দোল উৎসব!

মিষ্টি এই উৎসবের সবচাইতে জনপ্রিয় উপহার। যেহেতু উৎসবটি রং নিয়েই তাই কিশোর এবং তরুণদের মধ্যে রঙের প্যাকেট একটি উল্লেখযোগ্য উপহার। এই উৎসবের তাৎপর্য একে অন্যের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের সবচাইতে ভালো উপায় পছন্দের মানুষকে মিষ্টি মুখ করানো। হিন্দু ধর্মের কোন কোন গোত্র এই দিনে বিবাহিত মেয়েকে এবং মেয়ের জামাইকে নতুন কাপড় উপহার দেয়।

হোলির আগের দিন শ্রী কৃষ্ণের পূজা করা হয়। তখন শুকনো রং ছিটানো হয়। এই হোলির জন্য শাঁখারী বাজারে প্রায় লাখ টাকার রং আবির এবং বিভিন্ন ওয়াটার গান বিক্রি হয়। হোলির আগের দিন কেবল পরিচিতদের মাঝেই শুকনো রং ছিটানো হয়। বিভিন্ন ধরনের দেশি-বিদেশি রংয়ের পসরা নিয়ে বসে দোকানিরা। হোলি খেলার দিন তাঁতীবাজার, সুতার নগর, শাঁখারীবাজার, গোয়াল নগর, রায়সাহেব বাজার, ঝুলববাড়িসহ আরও কিছু কিছু মহল্লার দোকানগুলো হোলি খেলার সময়ে বন্ধ থাকে।

কেউ কেউ হোলি না খেললেও জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অথবা বাড়ির ছাদে উঠে উপভোগ করেন হোলি খেলা। এক্ষেত্রেও ভয় রয়েছে কারণ কোন দুষ্টু ছেলে দেখলেই রং ভর্তি বেলুন ছুড়ে মারতে পারে অথবা ওয়াটার গান দিয়ে রং মারতে পারে। রং খেলা শেষে অনেক ছেলেরা দল বেঁধে

বুড়িগঙ্গা নদীতে গোসল করতে যায়। তবে গায়ে রঙের দাগ লেগে থাকে প্রায় সপ্তাহব্যাপী। অনেকে রং খেলে অসুস্থও হয়ে পড়েন। এ ছোটখাটো সমস্যার কথা মাথায় রেখেই সবাই মেতে উঠে পুরনো ঢাকার হোলি উৎসবে।

তবে হোলি খেলা নিয়ে অনেক বিড়ম্বনায় পড়েন ওইসব এলাকার অনেক মুরব্বিরা। অনেক জরুরি কাজেও যদি কেউ বের হয় তবে দুষ্টু ছেলের দলেরা তাদের রেহাই দেয় না। যারা অফিস করবে তারা সকালে হোলি খেলা শুরু হওয়ার আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

পুরান ঢাকার হোলি খেলার দিনে ‘বান্দইরা রং’ নামের একটি রং ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। ওই রংটি লাগানোর পর মানুষের চেহারা বিকৃত হয়ে যায় আর সেই বিকৃত চেহারাকে বানরের সঙ্গে উপহাস করে মেলানোর জন্যই এই রংয়ের নাম বান্দইরা রং।