‘বাস্তবায়ন হয়েছে শান্তিচুক্তির সিংহভাগ, থাকবে না ভূমি বিরোধও’

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সিংহভাগ বাস্তবায়ন হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রধান বিরোধের ক্ষেত্র ভূমি বিরোধেরও সমাধান হবে। প্রধান বিরোধের ক্ষেত্র ভূমি সংস্কারের জন্য এরই মধ্যে কমিশন গঠন করা হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই কমিশন বসতে পারলেই ভূমি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। রবিবার পার্বত্য অঞ্চলে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নাগরিক সেবা দিতে চার হাজারতম পাড়া কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। রাজধানী থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন তিনি।

এ সময় পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে সরকারের নানা উদ্যোগ বর্ণনা করে বলেন, সরকার কোনো একটি অঞ্চলকে বঞ্চিত করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। আর সংঘাতের জন্য যেহেতু পার্বত্য অঞ্চল ২০ বছর পিছিয়ে ছিল তাই এই অঞ্চলের জন্য সরকার বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে। ১৭টি প্রকল্পে সেখানে আলাদাভাবে ১০ হাজার কোটি টাকার উন্নয়নের কাজ চলছে। এর বাইরে সব মন্ত্রণালয়ের কাজও চলছে।

এর মধ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর করা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির প্রসঙ্গও টানেন প্রধানমন্ত্রী। এই চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি অভিযোগ করে সরকারের সঙ্গে চুক্তিতে সই করা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি অসহযোগ আন্দোলনের ‍হুমকি দিয়েছে। আবার নতুন করে অস্ত্র ধরার হুমকিও এসেছে। জনসংহতি সমিতির অভিযোগ, চুক্তির নানা বিষয় বাস্তবায়নে অগ্রগতি থাকলেও ভূমি বিরোধের মীসাংসা হয়নি এখনও।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যে শান্তিচুক্তি আমরা করেছি তার সিংহভাগ বাস্তবায়ন করেছি, আর যেটা বাকি আছে সেটাও আমরা করব। ভূমি কমিশন আমরা গঠন করে দিয়েছি। এই ভূমি কমিশন যদি বসতে পারে তাহলেও সমস্যার সমাধান হতে পারে।’‘যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আইন আমরা করেছিলাম, আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করার সময় সেই আইনটার সংস্কার করেছিলাম আঞ্চলিক পরিষদের চাহিদা মতে। এখন আর কোনো সমস্যা থাকার কথা না।’

প্রধানমন্ত্রী পার্বত্য এলাকার ভূমির মালিকানা পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনার কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘জমির মালিকানা সেই ব্রিটিশ আমলে করা আইন দিয়ে না। বরং আমাদের সব এলাকার মানুষ যেমন ভূমির মলিকানাটা পায় পার্বত্য অঞ্চলের মানুষও যেন ভূমির মালিকানাটা যেন সেই ভাবে নিতে পারে, আমরা সেই ব্যবস্থাই করতে চাই। ‘ওই মালিকানা তাদের নিজস্ব থাকবে, এটাই আমরা নিশ্চিত করতে চাই।’

পার্বত্য অঞ্চলে ভূমি সমস্যার জন্য সেনা শাসকদের দায়ী করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘১৯৭৫ সালে জাতির জনককে হত্যার পর মিলিটারি ডিকটেটররা যখন ক্ষমতা নেয়, তখন সমস্যাটা আরও প্রকট করে। সমতল ভূমি থেকে বিভিন্ন লোকদের নিয়ে ওখানে বসতি করা শুরু করে দেয়, তাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে রাখে। সেখানে সংঘাতটাকে আরও উস্কে দেয়া হয়।’

শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমরা চুক্তির প্রায় ৭০ থেকে ৮০ ভাগ বাস্তবায়ন করেছি। …যেমন খাগড়াছড়িতে ২৯টা বিষয় আমরা হস্তান্তর করেছি, বান্দরবানেও ২৮টা বিষয় হস্তান্তর করা হয়েছে আর রাঙ্গামাটিতে ৩০টা বিষয় হস্তান্তর করা হয়েছে।’ ‘আড়াইশর মতো সেনা ক্যাম্প আমরা প্রত্যাহার করে নিয়েছি। সেখানে সার্বিক নিরাপত্তার জন্য আগে কখনও বর্ডার গার্ডের বিওপি ছিল না। আমরা বিওপিগুলো তৈরি করে দিচ্ছি।’

প্রধানমন্ত্রী জানান, ২০১৮ সালের ১০ জানুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে অস্ত্র সমর্পণ করা ১৮০০ জনকে পুলিশ, আনসার ভিডিপিতে কাজের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। ‘আমরা ইতিমধ্যে রাজার ভাতা বাড়িয়ে দিয়েছি। হেডম্যান, কারবারির ভাতা বাড়িয়ে দিয়েছি।’

‘শান্তি চাই, শান্তি হচ্ছে উন্নয়নের পূর্ব শর্ত’ এমন মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার নিজের দেশের অভ্যন্তরে কোনো অশান্তি থাকুক সেটা আমরা চাই না।’ ‘আমি পার্তব্য অঞ্চলের মানুষকে বলব যে, শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। কারণ শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ছাড়া উন্নতি সম্ভব নয়। আর সেটা মাথায় রেখেই সকলকে এক যোগে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি।’

রাঙ্গামাটিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পুল-ব্রিজ করার বিষয়টিও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। ‘খাগড়াছড়িতে থানচি সেতু নির্মাণ করতে যেয়ে সেনাবাহিনীর পাঁচ-ছয় জন সদস্য নিহত হয়েছে। আমরা সব জায়গায় যোগাযোগ ব্যবস্থাটা উন্নত করে দিচ্ছি। পাশাপাশি বিদ্যুতের ব্যবস্থা, যেখানে যেখানে গ্রিড লাইন নাই, সেই সব অঞ্চলে গ্রিড লাইন তৈরি করে দিয়েছি।’ পার্বত্য অঞ্চলের যে তিনটি জাতিগোষ্ঠী ভাষার বর্ণমালা আছে সে্ই ভাষায় বই ছাপিয়ে তা বিতরণের কথাও জানান প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা চাই না ওখানে কোনো ড্রাগফিল্ড থাকুক, পপি ‍উৎপাদন হোক। এ জন্য আমরা প্রথমে শুরু করলাম ভুট্টা চাষ, সেই সাথে সাথে আমরা এখন মিশ্র ফলের বাগান… পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন খুব ভালো আম হচ্ছে, কমলালেবু হচ্ছে।’ ‘সাজেক ভ্যালিতে এক সময় যেতে গেলে সাত দিন হেঁটে যেতে হতো। আমরা আজকে সেখানে রাস্তা করে দিচ্ছি, সবচেয়ে ভালো কমলা হয় সেখানে।’ ‘আমরা চাই সেখানে ফুড প্রসেস ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হবে। এতে কর্মসংস্থান হবে এবং প্রক্রিয়াজাত করে বাইরে রপ্তানি হবে।’

পার্বত্য এলাকার তাঁত শিল্পের প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী তার গায়ে থাকা ওড়নার মতো উত্তরীয় দেখিয়ে বলেন, ‘চাদরও পেয়েছি, সেটাও পরব, আমি বিকালেই ওটা পরে পার্লামেন্টে যাব। কারণ, আমি গুরুত্ব দিচ্ছি।’ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সইয়ের কথা বর্ণনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার জনসংহতি সমিতির সঙ্গে যোগাযোগের পাশাপাশি ভারতে যাওয়া প্রায় ৬৪ হাজার শরণার্থীর সঙ্গেও আলোচনা শুরু করে।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীরঅফিসে বসে প্রায়ই গোপনে মিটিং হতো, সেই সঙ্গে জাতীয় সংসদের যে জাতীয় কমিটি সেই কমিটিও বসত। এভাবে আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা শান্তি চুক্তি করতে সক্ষম হই।’ এক বছরের আলোচনায় কোনো তৃতীয় শক্তির সহযোগিতা নেয়া হয়নি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার দেশের নাগরিক, তাদের সমস্যাটা আমরা যদি জানতে না পারি, তাহলে বাইরের লোক কীভাবে বুঝবে।’ ‘আমরা রোগ নির্ণয় করতে পেরেছিলাম বলেই দ্রুততম সময়ে শান্তিচুক্তি আমরা করি। আর শুধু শান্তিচুক্তিই না, বাংলাদেশ বোধহয় প্রথম দেশ সারা বিশ্বে, বিশ্বে অনেক দেশেই শান্তিচুক্তি হয়েছে কিন্তু অস্ত্র সমর্পণ হয়নি।’

এরপর ভিডিও কনফারেন্সে একটি পাড়া কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আশিষ কুমার তণ্চ্যঙ্গা, পাড়া কেন্দ্রের উপকারভোগী রোজিনা আক্তার, একজন হেডম্যান, সাবেক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার, সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম পিনু, রাঙ্গামাটির সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্থানীয় কিছু দাবি তুলে ধরেন।

সবশেষে প্রধানমন্ত্রী বলেনম পাড়াকেন্দ্রের প্রকল্প শেষ হয়ে যাচ্ছে আগামী ৩১ ডিসেম্বর। এই প্রকল্প শেষ হলে নতুন একটি প্রকল্প শুরু হবে। পুরনো প্রকল্পের সবাইকেই নতুন প্রকল্পে সম্পৃক্ত করা হবে।