রাজ্য জয়ের লড়াইয়ে মরিয়া গান্ধী ও মোদী!

ভারতের রাজনীতিতে যাবতীয় মনোযোগ এখন গুজরাটের আসন্ন নির্বাচনে – যেখানে বিজেপির একটানা প্রায় তেইশ বছরের শাসন অক্ষুণ্ণ রাখতে অক্লান্ত প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। অন্য দিকে গুজরাট দখলে আনার মরিয়া চেষ্টায় রীতিমতো ওই রাজ্যের মাটি কামড়ে পড়ে আছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীও।

গুজরাটে সাম্প্রতিক বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন কিংবা নোট বাতিল-জিএসটির মতো বিতর্কিত অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তকে ঘিরে বিজেপির বিরুদ্ধে রাজ্যে তীব্র ক্ষোভ আছে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু সেটা কি ভারতে বিজেপির সবচেয়ে বড় দুর্গে ফাটল ধরানোর জন্য যথেষ্ট? গত কয়েকদিন ধরে গুজরাটের নানা প্রান্তে ঘুরে এই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজেছিলাম।

গুজরাটের আহমেদাবাদে সবরমতী নদীর তীরে মোহনদাস গান্ধীর নিজের হাতে গড়া সবরমতী আশ্রম – বিকেলে সেখানে বাজছে গুজরাটি ভাষায় লেখা গান্ধীর প্রিয় ভজন ‘বৈষ্ণবো জান তো’। ছশো বছরেরও বেশি পুরনো এই গান সবার দু:খ-দুর্দশা অনুভব করার কথা বলে, সবাইকে মর্যাদা দেবার কথা বলে। তবে গান্ধীর প্রয়াণের প্রায় সত্তর বছর পর তার জন্মভূমিতে রাজনৈতিক বাস্তবতা আজ অনেকটাই অন্যরকম। গত প্রায় সিকি শতাব্দী ধরে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি এ রাজ্যে অনায়াসে ক্ষমতায় রয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও গুজরাট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হিতেশ প্যাটেল বলছিলেন, “শাসক দল বিজেপির জন্য সারা দেশে তাদের যাবতীয় আদর্শগত পরীক্ষানিরীক্ষার ল্যাবরেটরি হল গুজরাট।”

“জাতীয় স্তরে গুজরাটের গৌরব নিয়েও এ রাজ্যের মানুষ খুব ভাবিত – আর মোরারজি দেশাইয়ের পর বহুদিন পর আর এক গুজরাটি নরেন্দ্রভাই দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এই রাজ্যে একটা বাণিজ্যিক সংস্কৃতিও আছে, যে বাণিজ্যিক ভাবনাটা তাদের রাজনীতিতেও জাতীয় চিন্তাধারার সঙ্গে চলতেই প্রভাবিত করে।”

ফলে ২০১৭-র নির্বাচনেও বিজেপির গুজরাটে ক্ষমতায় আসা নিয়ে সংশয়ের কোনও কারণ থাকার কথা ছিল না। কিন্তু গত দু-এক বছরে বেশ কয়েকটা ঘটনা বা দুর্ঘটনা সেই আপাত-সহজ সমীকরণকেই বেশ জটিল করে তুলেছে। এ রাজ্যের পথেপ্রান্তে কান পাতলেই এখন শোনা যায় বিজেপির সরকার ধনীদের জন্য – গরিবের জীবন যেন এখানে আটার চাকিতে পিষে ফেলা হচ্ছে। রাজ্যের বস্ত্রশিল্পে কাজ করেন যে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক, গত সাত মাসে নোট বাতিল আর জিএসটি কর চালুর ধাক্কায় তাদের রুটিরুজি বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়েছে। আহমেদাবাদ শহরে নেহরুনগর মার্কেট রাতারাতি বন্ধ হয়ে গেছে, পথে বসেছেন দুশো শ্রমিক পরিবার। আর এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজ্যে তিন তরুণ তুর্কির সামাজিক আন্দোলন।

অল্পেশ ঠাকোর, হার্দিক প্যাটেল ও জিগনেশ মেহভানি নামে গুজরাটের তিন তরুণ নেতা যথাক্রমে নেতৃত্বে দিচ্ছেন ওবিসি, পাতিদার ও দলিত শ্রেণীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনে – আর ভোটের মুখে তারা তিনজনেই হাত মিলিয়েছেন বিরোধী কংগ্রেসের সঙ্গে। তাদের তিনজনের দাবিতে পরস্পর বিরোধিতা হয়তো আছে, কিন্তু অল্পেশ ঠাকোর নিশ্চিত বিজেপির বিরুদ্ধে একটা নতুন ভাবনা, নতুন উৎসাহের ঝড় তাদের ঠিকই ক্ষমতায় নিয়ে আসবে। আর বিজেপিকে হয়তো এবারে গুজরাটের মসনদ থেকে সরানো একেবারে অসম্ভব নয়, সেটা টের পেয়েই গত তিন মাস ধরে এ রাজ্যে লাগাতার প্রচারণা চালাচ্ছেন ভাবী কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী – আর তিনি সরাসরি আক্রমণের নিশানা করেছেন গুজরাটে বিজেপির তথাকথিত উন্নয়নের মডেলকে।

গুজরাট এবার দখলে নিতে চায় কংগ্রেস

“বিজেপির মিথ্যার ফুলঝুরিতে উন্নয়ন বা বিকাশের ধারাই পথভ্রষ্ট হয়েছে, বিকাশ পাগল হয়ে গেছে”, একের পর এক সভায় বলে চলেছেন তিনি। আর ঠিক এমন এক পটভূমিতেই গুজরাটের নির্বাচনী রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। তার স্বপ্নের গুজরাট মডেলের মূল কথা যে বিকাশ, তাকে নিয়ে কোনও ব্যঙ্গবিদ্রূপ যে তিনি সইবেন না, সেটা তিনি পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন। জনসভা থেকে মুহুর্মুহু শ্লোগান দিচ্ছেন আমিই বিকাশ, ‘হু বিকাশ ছো’। মোদির গুজরাট মডেল রাজ্যে রাস্তাঘাট, ড্যাম, বৃহৎ শিল্প স্থাপনে সফল হলেও শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক উন্নয়নের সূচকে ব্যর্থ – এই সমালোচনা অবশ্য বহুদিন ধরেই ছিল। কিন্তু বিদগ্ধ অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের গণ্ডি পেরিয়ে তা এখন সাধারণ আম গুজরাটিদেরও চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে।

আহমেদাবাদের প্রাণকেন্দ্রে তরুণ-তরুণীরা ফ্ল্যাশ মবের মতো হঠাৎ উদয় হয়ে নাচতে শুরু করে দিচ্ছে ‘বিকাশ গান্ডো থায়ো চে’ গানের সঙ্গে – গুজরাটিতে যার অর্থ ‘বিকাশ পাগল হয়ে গেছে’। বিরোধী কংগ্রেসের তৈরি করা এই গান সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে সর্বত্র দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে – বাধ্য হয়ে বিজেপিকেও বের করতে হয়েছে যার পাল্টা ভিডিও। দিল্লি বিজেপির নেতা সতীশ উপাধ্যায় গুজরাটে দলকে ভোটে জেতানোর দায়িত্ব নিয়ে এ রাজ্যে পড়ে আছেন। তার অবশ্য বিন্দুমাত্র সংশয় নেই, এই উন্নয়নই বিজেপিকে জেতাবে – এবং গুজরাটিরা কিছুতেই এমন একটা দলের বিরুদ্ধে যাবেন না, দিল্লিতেও যাদের সরকার আছে।

“হাজার হোক, সারা দেশে আর কোন রাজ্যে প্রত্যন্ত গ্রামেও একশো-দুশো টাকায় ডায়ালিসিস করা যায়? তারা এই উন্নয়নের ধারায় কোনও ব্যাঘাত চাইবেন না – সেই সঙ্গে অবশ্যই কাজ করবে মোদি ক্যারিশমা, গুজরাটিদের জন্য যিনি অনেক করেছেন”, বলছিলেন মি উপাধ্যায়।

কিন্তু মোদি শূন্যগর্ভ এই প্রতিশ্রুতি আর গুজরাটি অস্মিতার তত্ত্ব ভাঙিয়ে আর কতদিন খাবেন, পাল্টা প্রশ্ন প্রদেশ কংগ্রেসের মুখপাত্র মনীশ দোশীর। তিনি বলছেন, “এটা ঠিকই যে প্রত্যেক রাজ্যেই দেখা যায়, তার নিজের লোক যখন নেতৃত্ব দেন তার ওপর একটা ভরসা কাজ করে। কিন্তু বারবার কি একই জিনিস চলে না কি?”

“২০০২য়ে গুজরাটি গৌরবের কথা বলে, ২০০৭য়ে বিভাজনের রাজনীতি করে – বা তার পরেও কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার কথা বলে আপনি ভোটে জিতলেন। কিন্তু গুজরাটিদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে তো একটা টাকাও জমা পড়ল না!”

তবু গুজরাটে বিজেপির ভোট মেশিনারি কিংবদন্তির মতো। জিএসটি করই হোক বা পাতিদার সমাজকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফেরত আনা – যুদ্ধকালীন ভিত্তিতে নানা পদক্ষেপ নিয়ে তারা মানুষের ক্ষোভ কিছুটা প্রশমিত করতে পেরেছেন অবশ্যই। মোদী-অমিত শাহর খাসতালুক মেহসানাতে ব্যবসায়ীরা এখন বলছেন, কংগ্রেস আমলের তুলনায় সরকার এখন অনেক বেশি কাজকর্ম করছে, উন্নয়ন করছে। আর জিএসটি নিয়েও যা ক্ষোভ-বিক্ষোভ ছিল, সব না কি এখন ‘সেট’ হয়ে গেছে! আর বিজেপির পুরনো ভোট ব্যাঙ্ক পাতিদার-রাও হার্দিক প্যাটেলের কথায় বিভ্রান্ত না-হয়ে পুরনো দলের কাছে ঠিকই ফিরে আসবেন, এই বিশ্বাসে অটল বিজেপির আহমেদাবাদ শাখার প্রধান কমলেশ প্যাটেল।

তার যুক্তি, “পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে যারা প্যাটেল সমাজের জন্য কাজ করছে, সেই দলকে ভুলে গিয়ে এক চব্বিশ-পঁচিশ বছরের যুবকের কথায় তারা কি ভড়কে যাবেন না কি? হ্যাঁ, একবার হয়তো ওর উল্টোপাল্টা কথায় ভুল বুঝেছিলেন, কিন্তু পরে তারাও বুঝতে পেরেছেন কারা তাদের সত্যিকারের ভাল চায়।”

একান্ত আলোচনায় বিজেপি নেতারাও অবশ্য স্বীকার করেন, এবারের লড়াই কঠিন। কিন্তু মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভ যতই থাক, একজন গুজরাটি প্রধানমন্ত্রী যখন তাদের কাছে ভোট চাইছেন গুজরাট শেষ পর্যন্ত কিছুতেই তাকে নিরাশ করবে না – এটাই তাদের বড় ভরসা। প্রফেসর হিতেশ প্যাটেলও বলছিলেন, “আঞ্চলিকতার রাজনীতি কখনও এ রাজ্যে সফল হয়নি। চিমনভাই প্যাটেলের মতো পাটিদারদের বিরাট নেতাও কিমলোক নামে নিজের পার্টি তৈরি করেছিলেন, সফল হননি। শঙ্কর সিং বাঘেলা বা কেশুভাই প্যাটেল, হিন্দিচাচার মতো দিকপালরাও পারেননি।”

“বিজেপি সামান্য হলেও এগিয়ে থাকবে শুধু এই কারণে যে গুজরাট চিরকাল ভারতের রাষ্ট্রীয় রাজনীতির ধারার সঙ্গেই গা ভাসিয়েছে – যদিও তার পরেও তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ থাকছেই”, বলছেন তিনি।

বিজেপির শক্ত গড় গুজরাটে ২০১৭র বিধানসভা নির্বাচন দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে যে প্রবল উৎকণ্ঠা তৈরি করেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু বিরোধী কংগ্রেসের চ্যালেঞ্জ রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদলের জন্য যথেষ্ট, সেই কথাটা এখনও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। বিজেপি নেতারাও তাই সাবধানী আত্মবিশ্বাসের সুরে বলছেন, “১৮ ডিসেম্বরে ভোট গণনার পর মিলিয়ে নেবেন – সবরমতী আশ্রমে যেমন গান্ধী থাকবেন, গান্ধীনগরের সচিবালয়েও তেমনি বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীই থাকবেন।”

আর বিরোধী শিবিরের পাল্টা জবাব, “মনে রাখবেন গান্ধী নিজেও একজন কংগ্রেসিই ছিলেন। তার নিজের জন্মভূমিও আর খুব বেশিদিন কংগ্রেসের আদর্শ থেকে দূরে সরে থাকবে না, শুধু কয়েকটা দিন অপেক্ষা করুন!”