ক্যান্সার রোগিদের জীবন ফিরিয়ে দিচ্ছে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা 

মারণরোগ ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধে ক্রিকেটার যুবরাজ সিংহের লড়াই কারও অজানা নয়৷ ক্রিকেট মাঠের মতোই ছক্কা হাকিয়ে ক্যান্সারকে শরীর থেকে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন যুবি৷ এ রাজ্যেও তেমন এক যুবরাজ রয়েছেন৷ তিনি অবশ্য ২২ গজের খেলোয়াড় নন৷ সাধারণ মানুষ হয়েই ক্যান্সারকে হারিয়ে নজির গড়েছেন৷

কেমোথেরাপি কিংবা রে নয়৷ যে চিকিৎসাশাস্ত্রকে অনেকেই অবজ্ঞা করেন, সেই হোমিওপ্যাথির জাদুতেই ক্যান্সারকে হার মানিয়ে জয়ী হয়েছে বাংলার যুবরাজ৷ আর এই ‘ম্যাচে’ তাঁর ক্যাপ্টেন ডাক্তার সুনির্মল সরকার৷ তাঁর তিন বছরের চিকিৎসাতেই লাস্ট স্টেজ লিভার ক্যান্সারের রোগী আজ সম্পূর্ণ সুস্থ জীবন ফিরে পেয়েছেন৷ তাঁর শরীর থেকে নিশ্চিহ্ন হয়েছে ক্যান্সার৷

বছরকয়েক আগে বর্ধমানের স্নেহাশিস দত্তের (নাম পরিবর্তিত) আল্ট্রাসোনোগ্রাফি রিপোর্ট দেখে তাবড় ক্যান্সার চিকিৎসকেরা বলেই দিয়েছিলেন, মৃত্যুর জন্য দিন গোনা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই৷ ক্যান্সার রূপে মৃত্যুর হাতছানি দিচ্ছে স্বয়ং যমরাজ৷ সেই ব্যক্তির জীবনে এখন নতুন সঙ্গী তাঁর স্ত্রী৷ বিয়ে করে দিব্যি সুখে সংসার করছেন৷ ক্যান্সারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়া স্নেহাশিস এখন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সফলভাবে চাকরি করছেন৷ ধন্যবাদ দিচ্ছেন হোমিওপ্যাথিকে৷ জীবন ফিরিয়ে দেওয়া হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক সুনির্মল সরকার তাঁর ভগবান৷

কিন্তু কীভাবে সম্ভব হল এই চমৎকার?

হোমিওপ্যাথিতে ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা করা চিকিৎসক সুনির্মল সরকার বলছেন, ‘‘যে কোনও দুরারোগ্য রোগকেই সারানো যায় যদি রোগীর মানসিক দিক থেকে চিকিৎসা করা হয়৷ ক্যান্সার হলেই যে কোনও রোগী মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে৷ কার্যত মৃত্যুকে বরণ করেই নেয়৷ সেক্ষেত্রে আমরা আগে রোগীর মনের জোর বাড়াই৷ এক্ষেত্রেও স্নেহাশিসকে আগে মনের জোর দিয়েছি৷ তাই প্রথম ওষুধেই ভাল ফল মিলেছে৷” তাঁর আরও বক্তব্য, “সব ধরণের ক্যান্সারেই হোমিওপ্যাথিতে ভাল ফল মেলে। বিশেষত প্যানক্রিয়াটিক, গলব্লাডার এবং লিভার ক্যান্সারের মতো জটিল ক্যান্সারে কেমোথেরাপি ছাড়াই হোমিওপ্যাথিতে যে ভাল ফল মেলে, এটা তারই উদাহরণ৷’’

২০১৩ সালে হঠাৎ পিঠে এবং পেটে ব্যথা নিয়ে বর্ধমানের একটি হাসপাতালে ভর্তি হন স্নেহাশিস৷ সেখানে গ্যাস আর ব্যথার ওষুধ দিয়ে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়৷ ফের ব্যথা উঠলে আল্ট্রাসোনোগ্রাফি পরীক্ষা করে দেখা যায় গলব্লাডারে পাথর হয়েছে৷ অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকেরা৷ কিন্তু মেডিক্যাল টিমের এক চিকিৎসক ফের আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করান৷ সেই রিপোর্ট দেখে মেডিক্যাল টিমের সন্দেহ হয়৷ বিপদজনক রিপোর্ট দেখে অস্ত্রোপচার না করার সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকেরা৷ রোগীকে তখনও জানানো হয়নি শরীরে বাসা বেধেছে মারণরোগ৷ গোলব্লাডার থেকে ক্যান্সার ছড়িয়েছে লিভারেও। পরিস্থিতি দেখে রেফার করা হয় রাজারহাটের নামকরা ক্যান্সার হাসপাতালে৷ সেখানে প্রথমে বলা হয় লিভার কেটে বাদ দিতে হবে৷ পরে অবশ্য তা না করে স্টেন্ট বসানো হয় শরীরে৷ কিন্তু শেষমেষ সেই হাসপাতালও জানিয়ে দেয়, অস্ত্রোপচার করলে জীবনহানি হতে পারে৷ তাই তাঁরাও ঝুঁকি নেবেন না৷
একে একে সব আশা শেষ হতে লাগল স্নেহাশিসের৷

শেষ ভরসা হিসেবে ছুটলেন দক্ষিণ ভারতে৷ ভেলোড়ে গিয়ে তাঁর শরীরের সবরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হল৷ আতস কাঁচের নীচে তাবড় ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা খুঁটিয়ে দেখলেন সেইসব পরীক্ষার রিপোর্ট৷ কিন্তু সেখানেও আশা জাগানো কোনও উত্তর দিতে পারলেন না কেউই৷ তবে এক চিকিৎসক স্নেহাশিসকে আশা জাগিয়ে জানালেন, তিনি অস্ত্রোপচারের ঝুঁকি নেবেন৷ লাখ কুড়ি টাকা জোগাড় করতে বলা হল৷ আত্মবিশ্বাসী স্নেহাশিস সেই চিকিৎসকের কাছে জানতে চান, এত টাকা খরচ করে অস্ত্রোপচারের কতটা আশা আছে? সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার কোনও আশা দিতে পারলেন না তিনিও৷

অগত্যা কলকাতায় ফিরে আসা৷ তবে ততক্ষণে ইন্টারনেট ঘেঁটে তিনি হোমিওপ্যাথিতে ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা করা চিকিৎসক সুনির্মল সরকারের কথা জেনেছেন স্নেহাশিস৷ কলকাতায় ফিরেই ছুটলেন সল্টলেকে সুনির্মলবাবুর চেম্বারে৷ সেখান থেকেই নতুন জীবনের যাত্রা শুরু৷ স্নেহাশিসের কথায়, ‘‘প্রথম আমি গাড়িতে শুয়ে গিয়েছিলেন ডাক্তারের চেম্বারে৷ কিন্তু প্রথমবারের ওষুধ খেয়ে আমি উঠে দাড়ানোর ক্ষমতা পেয়েছিলাম৷ দ্বিতীয়বার হেঁটে যেতে পেরেছিলাম৷ তখন অদ্ভুত মানসিক জোর পেয়ে গিয়েছিলাম৷ কিন্তু ভাবিনি যে আমি সুস্থ হয়ে উঠব৷ তারপর টানা তিনবছর চিকিৎসা চলেছে৷ প্রত্যেকবারের রিপোর্টেই দেখতে পাচ্ছি, শরীর থেকে চলে যাচ্ছে ক্যান্সার৷ শেষমেষ বছরখানেক আগে ডাক্তারবাবুর পরামর্শে চাকরিতে যোগ দেওয়ার ক্ষমতা ফিরে পাই৷ শেষ রিপোর্টে জানিয়ে দেওয়া হল, শরীরে ক্যান্সারের জীবাণু আর নেই৷ এ বছর বিয়ে করেছি৷ সুনির্মল ডাক্তার আমার জীবন ফিরিয়ে দিয়েছেন৷ এটা হোমিওপ্যাথির চমৎকার৷’’

সুনির্মলবাবুর কথায়, ‘‘হোমিওপ্যাথি শাস্ত্রে আমরা প্রত্যেক রোগীর শারীরিক, মানসিক এবং পারিবারিক ঘটনার কথা খেয়াল রাখি৷ ওঁর কিছু মানসিক উপশম ধরে চিকিৎসা শুরু করেছিলাম৷ কেমোথেরাপির বাইরেও হোমিওপ্যাথি পারে ক্যান্সার রোগীকে সুস্থ জীবন দিতে৷ কেমোথেরাপির বিকল্প বা পরিপূরক হোমিওপ্যাথি৷ শরীরে কাটাছেঁড়া না করে ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষকে সুস্থ করে তোলাই আমাদের লক্ষ্য৷’’

হোমিওপ্যাথিকে একসময় মানুষ অবজ্ঞা করলেও ডাক্তার সুনির্মলের চেম্বারে এখন ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে৷ সুস্থ হয়ে উঠছেন স্নেহাশিসের মতো আরও অনেকে৷ কিন্তু এই ঘটনাটিকে ‘মিরাকল’ বলছে খোদ চিকিৎসক৷ তাঁর লক্ষ্য সমাজকে ক্যান্সার মুক্ত করা৷ সেই লক্ষ্যেই এগোচ্ছেন সুনির্মল সরকার৷