সরকারি বিদ্যালয়ের ৫২২ শিক্ষককে বদলির সুপারিশ করেছে দুদক
প্রতিবেদনের ভাষ্য অনুযায়ী, অভিযুক্ত শিক্ষকরা একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন ১০-৩৩ বছর। দীর্ঘদিন ধরে একই প্রতিষ্ঠানে অবস্থানের সুযোগ নিয়ে সরকারি নির্দেশনা অমান্য করেই ভর্তি, কোচিং ও নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছেন তারা।
বছরের পর বছর ধরে একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থেকে ভর্তি, কোচিং ও প্রাইভেট বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের অভিযোগে ঢাকা মহানগরীর ২৪টি সরকারি বিদ্যালয়ের ৫২২ শিক্ষককে বদলির সুপারিশ করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তকারীরা। এ নিয়ে তারা দুদকে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও জমা দিয়েছেন।
জানা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বরে ঢাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ভর্তি, কোচিং বাণিজ্যের মাধ্যমে শিক্ষকদের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের একটি অভিযোগ নিয়ে অনুসন্ধানে নামে দুদক। কমিশনের পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের অনুসন্ধান দল প্রায় ১১ মাস অনুসন্ধানের পর গতকাল এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে।
প্রতিবেদনে শিক্ষকদের বদলি না করার পেছনে রাজনৈতিক চাপ, তদবির ও অনৈতিক আর্থিক লেনদেন রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এতে আরো বলা হয়, কোচিং বা প্রাইভেট বাণিজ্যের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে আসছেন কিছু শিক্ষক। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অনৈতিক সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে বছরের পর বছর ঢাকার একই বিদ্যালয়ে অবস্থানের সুযোগ পেয়েছেন তারা। এসব শিক্ষক প্রাইভেট পড়ানোর নামে নিজস্ব কোচিং সেন্টার গড়ে তুলেছেন এবং শিক্ষার্থীদের সেখানে পড়তে বাধ্য করছেন।
দুদকের অনুসন্ধানী দল রাজধানীর সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের ৩২ জন, মোহাম্মদপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৬, ধানমন্ডি গভর্নমেন্ট বয়েজ হাই স্কুলের ১৭, মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৪, শেরেবাংলা সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৭, সরকারি বিজ্ঞান কলেজ সংযুক্ত হাই স্কুলের ২৫, খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩১, তেজগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ২১, গণভবন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৪, মিরপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৯, নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৯, নারিন্দা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩১, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের ২৯, আরমানিটোলা সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ২১, ঢাকা গভর্নমেন্ট মুসলিম হাই স্কুলের নয়, ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের আট, মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩২, বাংলাবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ২২, টিকাটুলী কামরুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩০, তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৮, শেরেবাংলা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৪, ধানমন্ডি কামরুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সাত, ধানমন্ডি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নয় ও নিউ গভর্নমেন্ট গার্লস হাই স্কুলের সাতজন শিক্ষককে বদলির সুপারিশ করেছে।
অনুসন্ধানী দলের প্রতিবেদনে কোনো শিক্ষক এক নাগাড়ে এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১০ বছরের বেশি সময় কর্মরত থাকলে তাকে সংশ্লিষ্ট বিভাগের বাইরের কোনো বিদ্যালয়ে বদলির সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া পাঁচ বছরের বেশি সময় কর্মরত শিক্ষকদের ঢাকা নগরীর বাইরে এবং তিন বছরের বেশি সময় এক বিদ্যালয়ে কর্মরত থাকলে অন্য বিদ্যালয়ে বদলির সুপারিশ করেছে দুদক।
দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে অভিযোগ তোলা হয়, সাত জেলা শিক্ষা অফিসার নিজ নিজ জেলার দায়িত্বে না গিয়ে সুবিধামতো বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তারা হলেন— ঢাকার তেজগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, মোহাম্মদপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, ধানমন্ডি কামরুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, গাজীপুরের কালীগঞ্জ সরকারি বালক বিদ্যালয়, চট্টগ্রামের সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও বরিশালের সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এসব জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার বদলি নিশ্চিতের পাশাপাশি ভবিষ্যতে তাদেরকে শিক্ষক হিসেবে পদায়ন না করারও সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো কোনো বিদ্যালয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ইংরেজি শিক্ষক বা গণিত শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন। আবার কোনো কোনো বিদ্যালয়ে ইংরেজি বা গণিত শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে। এর পরও শিক্ষক সংখ্যায় সমন্বয় আনা হচ্ছে না, যার মূল কারণ হচ্ছে কোচিং বাণিজ্য ও সিন্ডিকেট।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, প্রতিবেদনটি কমিশনের কর্মকর্তা পর্যায়ে জমা হয়েছে বলে শুনেছি। তা এখনো কমিশন পর্যায়ে আসেনি। কমিশনে উপস্থাপিত হলে কমিশন পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মের শিক্ষা নিয়ে কারো ছিনিমিনি খেলার অধিকার নেই। এক্ষেত্রে আমাদের সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন। ঢাকায় প্রায় প্রতিটি বিদ্যালয়েরই সুরম্য ভবন রয়েছে। বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে যাচ্ছে। অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ রয়েছে। আমাদের মেধাবী শিক্ষকও রয়েছে। তার পরও কেন শ্রেণীকক্ষের শিক্ষা কোচিং সেন্টারে চলে যাচ্ছে? শ্রেণীকক্ষের শিক্ষা শ্রেণীকক্ষেই নিশ্চিত করা প্রয়োজন।