জাতীয় শুটিংয়ের সোনা জয়ী তুরিন চাকমা

রাঙামাটি নামটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক ক্যানভাস। বড় বড় পাহাড়ের গায়ে হেলান দেওয়া মেঘ, নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা নদী। অপরূপ সব দৃশ্যপট চোখে পড়বে বাংলাদেশের এই পাহাড়ি জেলা শহরে গেলে।

এই শহরেরই মেয়ে তুরিন দেওয়ান। রাঙামাটি থেকে উঠে এসে তিনি জয় করেছেন জাতীয় শুটিংয়ের সোনা। নতুন রেকর্ড গড়েছেন। এই তুরিন এখন স্বপ্ন দেখেন এশিয়ান গেমস ও অলিম্পিকে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার। তুরিন আত্মবিশ্বাসী, একটু সহযোগিতা পেলে তিনি নিজের লক্ষ্য পূরণ করতে পারবেন।

শুটিংয়ের প্রেমে পড়াটা তুরিনের হঠাৎ করেই। এ যেন প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ার মতো। ২০১৩ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হতে এসে দেখলেন, বন্দুক দিয়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্যভেদের এই খেলাই ‘সবচেয়ে সহজ’—অন্তত তুরিনের দৃষ্টিতে। খেলাটা যেহেতু ছোটবেলা থেকে পছন্দ করতেন, তাই বিকেএসপিতে ভর্তি হতে আসা। এখানে পড়লে খেলাধুলার সঙ্গে থাকা যাবে—ভাবনাটা ছিল এমনই। এখন শুটিংই তো তাঁর ধ্যানজ্ঞান। বুলেট-বন্দুক তাঁর ভালোবাসা।

শুটিংয়ে আসার ছয় বছরের মাথাতেই তুরিনের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। জাতীয় শুটিংয়ে জুনিয়র বিভাগে ২৫ মিটার পিস্তলে দুই বছরের মধ্যে দুবার রেকর্ড গড়েছেন। গত আসরের ৫১৯ স্কোর করে রেকর্ড গড়েছিলেন; সেই রেকর্ডই এবার ভেঙেছেন ৫৩৪ স্কোর করে। এখনো জুনিয়র বিভাগে খেললেও জায়গা করে নিয়েছেন জাতীয় দলে। ভারতের গুয়াহাটি-শিলংয়ে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ এসএ গেমসে ১০ মিটার পিস্তলে বাংলাদেশের দলগত রুপাজয়ী দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি।

দুই বোনের মধ্যে তুরিনই বড়। বাবা কুশপল দেওয়ান জাতিসংঘে চাকরি করেন। মা তুলি চাকমা গৃহিণী। বাবার ইচ্ছে ছিল বড় মেয়েটি পড়াশোনা করে বিরাট কিছু হোক—সেটি ডাক্তারও হতে পারে কিংবা ইঞ্জিনিয়ার। এর বাইরে বড় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে দারুণ চাকরি পাক—সে ইচ্ছাটাও বাবা ধারণ করতেন। তবে এখন শুটিংয়ে মেয়ের সাফল্য তাঁর চোখ খুলে দিয়েছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার তো সবাই হতে পারে। একটা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরিও যে-কেউই পেতে পারে। কিন্তু দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সৌভাগ্য কয়জনের হয়। মেয়ে যখন শুটিংটাকে গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছে, তখন এখানেই সে সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাওয়ার চেষ্টা করুক। তুরিনের এশিয়ান গেমস ও অলিম্পিক স্বপ্নকে উসকে দিয়েছেন বাবা কুশপলই। ২০২০ সালে টোকিও অলিম্পিকের জন্য বাংলাদেশ শুটিং ফেডারেশন যে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে, সেই দলে অন্যদের মধ্যে আছেন তুরিনও।

তুরিনের কাছে পুরো ব্যাপারটিই অবিশ্বাস্য। তাঁর বাবা-মা যে খেলাধুলায় তাঁকে সহায়তা করবেন, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন, এটা আগে কখনোই ভাবেননি। বাবা-মায়ের ‘আদুরে মেয়ে’ যাকে বলে, তুরিন তা-ই। চাচা সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা। তিনিই বিকেএসপিতে ভর্তি হতে তুরিনের বাবা-মাকে রাজি করিয়েছেন। পড়াশোনাটাও খুব ভালোমতোই চলছে সঙ্গে সঙ্গে। এএসসিতে খুব ভালো ফল হয়েছে। এ নিয়ে সবাই খুশি, তৃপ্ত। কাঁচা বয়সে যে অঙ্কটা তুরিন করেছিলেন, সেটি খুব ভালোমতোই মিলে গেছে। বিকেএসপিতে ভর্তি হয়ে শুটিং নেওয়ার মূল কারণ ছিল শারীরিক শ্রম দিতে হয়, এমন কোনো খেলা পাছে না আবার তাঁর পড়ালেখার ক্ষতি করে। কিন্তু শুটিংয়ের কারণে তাঁর নাকি মনেই হয় না যে তিনি জাতীয় পর্যায়ের একজন খেলোয়াড়!