কফিনে চুমু খাওয়ায় দর্শকরাও আবেগের সাগরে ডুব

নির্মাতা যতই দাবি করুন, দর্শকরা কিন্তু ঠিকই বুঝে নেবেন। কলকাতায় হুমায়ূন আহমেদকে জানেন, এমন বেশ কয়েকজন দর্শক পরিষ্কার করে বলে দিলেন, ‘ডুব’ ছবিতে হুমায়ূনকে নিয়ে বিতর্কিত অংশগুলোই দেখানো হয়েছে। আর যারা হুমায়ূন আহমেদের লেখার সঙ্গে পরিচিত, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে অন্ধকারে; তাঁদের মনেও প্রশ্ন আসবে, শুধুই কি গল্প বলা হয়েছে ‘ডুব’-এ? নাকি ঘটনার রি-মেক!

এর আগে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় কলকাতার আমির আলি এভিনিউয়ের একটি শপিং মলের প্রেক্ষাগৃহে আলোচিত ‘ডুব’ চলচ্চিত্রের প্রিমিয়ার শো উপলক্ষে সেখানে এসে পৌঁছান মুম্বাইয়ের প্রখ্যাত অভিনেতা ও ‘ডুব’ চলচ্চিত্রের প্রধান তারকা ইরফান খান। উপস্থিত ছিলেন ছবির নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা, পার্ণো মিত্রসহ ছবিটির অন্য কলাকুশলীরাও।

প্রিমিয়ার শুরুর আগে সাংবাদিকদের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে অভিনেতা ইরফান খান জানান, বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রে এই প্রথম অভিনয় করার সুযোগ পেয়ে তিনি খুশি। ফারুকীর মতো একজন গুণী নির্মাতার ছবি করতে পেরে তাঁর ভাল লেগেছে। ছবিটি দর্শকদের মন জয় করতে পারবে বলেও আশা করেন তিনি। নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী মনে করেন, সত্যজিৎ রায়ের শহরে ‘ডুব’-এর প্রিমিয়ার করতে পারা এবং এই শহরের মানুষের কাছে ‘ডুব’ ভালো লাগলেই তাঁর সার্থকতা আসবে।

হুমায়ূন আহমেদের জীবন নিয়ে তৈরি নয় ‘ডুব’ – এদিন আরও একবার পরিষ্কার করে দাবি করেন ফারুকী। তিনি বলেন, “এটা একটা বানানো গল্প। আমরা তো জানি না তাঁর (হুমায়ূন আহমেদ) জীবনে এমন কিছু ঘটেছে কী না। ‘ডুব’ নিয়ে বিশ্বের অনেক চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দিয়েছিলাম, আমরা দেখেছি আসলে আবেগের ভাষা একই। তিশা জানান, যে চরিত্রটির অভিনয় করছি সেই চরিত্রের মধ্যে ঢুকে যাওয়াটাই বড়কথা। সেটি তিনি চেষ্টা করেছেন বলে মনে করেন।

‘ডুব’ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে পার্ণো মিত্র বলেন, “ফারুকী ভাইয়ের ‘টেলিভিশন’, ‘পিপড়াবিদ্যা’ দেখার পরই তাঁর ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আর ‘ডুব’ এর প্রস্তাব পেয়ে আমি দারুণ খুশি ছিলাম। চল্লিশ দিন কাজ করেছি বাংলাদেশে। ‘ডুব’ যে মাত্রার চলচ্চিত্র সেই মাত্রার কাজ করার পর আরও ভালো কোন ছবির প্রস্তাব না পেলে হয়তো বাংলাদেশে ছবি করা সম্ভব হবে না।” ছবিটির ভারতীয় অংশের প্রযোজক অশোক ধানুকা জানান, “বাংলাদেশের বাজার অনেক ভালো। কিন্তু, সেখানে কম ছবি তৈরি হওয়ায় মার্কেট ছোট হয়ে আছে। আমরা চেষ্টা করছি সেখানে আরও ভালো কিছু ছবি বানাতে।”

‘ডুব’-এর প্রিমিয়ার দেখতে এসেছিলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা গৌতম ঘোষও। তিনি জানালেন, “খুবই ভালো লাগছে। যৌথ উদ্যোগে চলচ্চিত্র নির্মাণ হচ্ছে। ফারুকী নতুন প্রজন্মের নির্মাতা। ওর কাছ থেকে দর্শকরা অনেক আশা করেন। তবে যৌথ উদ্যোগের ছবির ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হচ্ছে অর্থ বিনিময় করা। বাংলাদেশ ও ভারত সরকারকে এটি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ ঢাকা-কলকাতার মধ্যে টাকা বিনিময় করা যায় না।”

অনুষ্ঠানে এসেছিলেন সংগীতশিল্পী অনুপম রায়। তিনি বললেন, “আমি ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ ও ‘টেলিভিশন’ ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ফারুকী ভাই আমার প্রিয় নির্মাতাদের মধ্যে একজন।” প্রয়াত কথা-সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমদের জীবন নিয়ে তৈরি ‘ডুব’, নাকি তাঁর জীবনের কিছুই নেই ছবিতে – এই নিয়ে বিতর্ক আরও উসকে উঠবে, যখন দর্শকরা পর্দায় ছবিটি দেখবেন – প্রিমিয়ার শো দেখার পর এমন মন্তব্য করেন কয়েকজন। তাঁদের মতে, পরিচালক ফারুকীর দাবি হয়তো দর্শকরাও মেনে নেবেন না। কেননা, ছবির গল্প, ঘটনা, চরিত্র এবং জায়গাগুলো পরিষ্কারভাবেই জানান দিচ্ছে এই ছবির সঙ্গে নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদের জীবনেরই মিল রয়েছে।

তবে যাঁরা ওই লেখককে চেনেন, কিন্তু তাঁর জীবন নিয়ে এই বিতর্ক জানেন না, সিনেমা হলে ছবি দেখতে গিয়ে তাঁরা কিন্তু জোর ধাক্কা খাবেন। যেমন খেয়েছেন কলকাতার বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও, যাঁরা ‘ডুব’-এর প্রিমিয়ার দেখেছেন।

কলকাতার একটি টেলিভিশন চ্যানেলের চিত্রসাংবাদিক সৌমেন রায় চৌধুরী ডুব চলচ্চিত্র দেখার পর পাশের আসনে বসা সাংবাদিক পরিতোষ পালকে প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা দাদা, জাভেদ হাসান বলে যে ব্যক্তির জীবন দেখানো হচ্ছে তিনি আসলে কে?” চরিত্রের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকায় ছবির গভীরে পৌঁছাতে পারেননি তিনি – হল থেকে বের হয়ে পরিতোষকে এভাবেই বুঝিয়েছেন সৌমেন। পরিতোষ তাঁকে বলেন, “এটি আসলে বাংলাদেশের একজন লেখকের জীবন নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্র।”

“কিন্তু কোথায় যেন একটি খাপ ছাড়া বিষয় রয়েছে” –। পরিতোষ পালের মন্তব্য, “ছবির দৃশ্যায়ন, ক্যামেরা, সাউন্ড এবং অভিনয় অসাধারণ। কিন্তু পরিচালক ছবির গল্প বলতে গিয়ে কিছু খণ্ড খণ্ড ঘটনার রি-মেক করেছেন সেটি স্পষ্ট।” কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রুবি চক্রবর্তীর ভাষায়, “দেখুন, আমরা হুমায়ূন আহমেদের গল্প পড়েছি। কিন্তু, তাঁর জীবনের এই ঘটনা জানি না। তবে, ডুব দেখে শুধুই হুমায়ূন আহমেদের নেতিবাচক বিষয়টিই জানলাম।”

নির্ধারিত সময় ৬টা ৪৫ মিনিটে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথোপকথনের কথা থাকলেও আয়োজকরা এই বিষয়টি সুষ্ঠুভাবে করতে ব্যর্থ হন। ফলে, ছবিটির মুখ্য অভিনেতা ইরফান খান, নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, অভিনেত্রী তিশা ভালো করে কথাও বলতে পারেননি। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর প্রতিনিধিরা হুড়মুরিয়ে পড়েন তাঁদের ওপর। যদিও কিছু বক্তব্য সেই সময় দিয়েছেন ওই তিনজনই।

প্রিমিয়ার শো দেখতে হলের পেছনের সারিতে পাশাপাশি বসেছিলেন নির্মাতা ফারুকী ও অভিনেত্রী তিশা। একটু দুরে বসেন ইরফান খান। পার্ণো মিত্র কিছু সময় পরে এসে বসেন তাঁদের সঙ্গে। শেষ দৃশ্যের আগে পপকর্ন খাচ্ছিলেন ফারুকী। কিন্তু তিশার চোখ ছিল পর্দার দিকে। বাগানবাড়িতে লেখকের কফিনের পাশে বসে বাবা ডাক শোনানোর চেষ্টা করছিলেন তিশা। কফিনে চুমু খাওয়ার সময় তিশার কণ্ঠে সেই বাবা ডাক শুনে হল ভর্তি দর্শকরাও আবেগের সাগরে ডুব দিয়ে ছিলেন কিছু সময়ের জন্যে।