‘সুবোধ’ আসলে কে, আতঙ্ক না অবহেলা?
‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা তোর ভাগ্যে কিছু নেই’, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, সময় এখন পক্ষে না’, ‘সুবোধ এখন জেলে! পাপবোধ নিশ্চিন্তে করছে বাস মানুষের হৃদয়ে’। সুবোধ আসলে কি, আতঙ্ক না অবহেলা? খাঁচায় বন্দী সূর্য হাতে অগোছালো চুল-দাড়ির এক তরুণের নাম সুবোধ। যার শরীরের তুলনায় পা অনেক বড়, যা অনেকটাই অসম্পূর্ণ। ছবি দেখে মনে হয়, ভালো আর মন্দের সাথে জীবন-মরণ লড়াইয়ে সে ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত। বিধ্বস্ত আর বিপর্যস্ত চেহারার এই সুবোধ ও তাকে উদ্দেশ্য করে লেখা বেশকিছু গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে রাজধানীর আগারগাঁও, মহাখালী ও পুরাতন বিমানবন্দরের দেয়ালে দেয়ালে।
এবার রহস্যময় সেই সুবোধকে খুঁজতে মাঠে নামছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এদিকে কারা কী উদ্দেশ্যে এই প্রচারণা চালাচ্ছেন সেটা এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তাই এর রূপকারদের খোঁজে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মাঠে নেমেছে।
সূত্রমতে গোয়েন্দাদের ধারণা, এসব গ্রাফিতি আর যাই কিছু হোক এর যারা রূপকার তাদের নিশ্চয় কোনো না কোনো উদ্দেশ্য আছে। সে উদ্দেশ্য জানতে গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থার চৌকস টিম মাঠে কাজ করছে। তাদের প্রধান লক্ষ্য এর রূপকার খুঁজে বের করা। তারা মনে করছেন, সরকারের বিরুদ্ধে একটি বিশেষ চক্র এমন গ্রাফিতির জন্ম দিয়েছে। তার রহস্য দ্রুত বের করতে না পারলে সচেতন মহলে এক ধরনের ভীতি ও আতঙ্ক বাড়তে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনীতির ভেতর থেকে কেউ কেউ জনমনে ভীতি সৃষ্টি করতে এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে। আবার হতে পারে, এসব গ্রাফিতির মধ্যে দেশের সবার জন্য বিশেষ কোনো বার্তা আছে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এ ধরনের গ্রাফিতিতে অবশ্যই মেসেজ (বার্তা) রয়েছে। তবে এগুলো কিসের বার্তা, সেটা বোঝা মুশকিল। যিনি বা যারা লিখেছেন তারাই বলতে পারবেন। ইতিহাস থেকে দেখা যায়, ১৮৮৭ সালের দিকে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে চারটি রুটি পাঠানো হতো। এই রুটি পাঠানোর মধ্যেও এক ধরনের মেসেজ ছিল। তাই এ গ্রাফিতের মধ্যেও বিশেষ কোনো বার্তা আছে, যা হয়তো আমাদের কাছে এখনও স্পষ্ট নয়।
এ প্রসঙ্গে মন্তব্য জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) আব্দুর রশিদ বলেন, ‘রাজনীতির ভিতর থেকে কেউ কেউ ভীতি সৃষ্টি করতে দেয়ালে এ ধরনের গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে। এগুলো প্রোপাগান্ডা, মানুষের মনে ভীতি সৃষ্টি করার কৌশল।’
তিনি বলেন, ‘জনমনে ভীতি সৃষ্টি করতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয়। একটি ব্যর্থ হলে আরেকটি নতুন কৌশল নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়। এ ধরনের দেয়াল লিখন তেমনি একটি কৌশল।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ‘শিক্ষা, রাজনীতি, মানুষের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের অগণতান্ত্রিকতা এবং গণবিরোধিতার প্রতি ইঙ্গিত করেই এগুলো প্রচার করা হচ্ছে বলে আমার ধারণা। তবে যারা এটি প্রচার করছেন তারাই এর মর্মার্থ ভালো বলতে পারবেন।
প্রসঙ্গত, খাঁচাবন্দি সূর্য হাতে পালিয়ে বেড়ানো এই ‘সুবোধ’ রাজধানীবাসির কাছে খুবই পরিচিত এক চরিত্র। ঢাকার আগারগাঁওয়ের দেয়ালে আঁকা কিছু গ্রাফিতিতে উঠে এসেছে সুবোধ নামের এই চরিত্র। কিন্তু এই সুবোধকে নিয়ে নগরবাসীর জনমনে দেখা দিচ্ছে নানা প্রশ্ন- এই সুবোধ কে? কেনই বা তাকে পালাতে হচ্ছে? আর কোথা থেকেই পালাবে সুবোধ? আর কাদের জন্যই সুবোধকে পালিয়ে যেতে হচ্ছে? আর কেই বা তাকে পালিয়ে যেতে বলছে?
একেবারে সাধারণ কয়েকটি স্থানের দেয়ালের গায়ের এমন দেয়ালচিত্র বা গ্রাফিতি অনেকের মনেই নাড়া দিয়েছে। আবার অনেকেই বলছেঃ কী আছে ওই গ্রাফিতিতে? আর এটি নিয়ে এত মাতামাতি করারি বা কি দরকার?
এসব প্রশ্নের নেই কোনো উত্তর। এর কোন সঠিক কারণও জানা যায় নি। তবে এই সুবোধকে নিয়ে আলোচনার ঝড়ও উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। সুবোধের এই ছবি কেউ কেউ প্রোফাইল ছবি বা কভার ছবি হিসেবে ব্যবহার করছেন। আবার ছবির কথাগুলোও স্ট্যাটাস হিসেবে দিচ্ছেন অনেকে।
এদিকে দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতিগুলোতে দেখা যাচ্ছে, এই সুবোধ কখনো হাতে বাক্সবন্দী সূর্য নিয়ে পালাতে উদ্যত, কখনো জেলে বন্দী, কখনো হতাশায় ঝুঁকে পড়া এক মানুষের প্রতিমূর্তি। কিন্তু এই সুবোধ বা তার সৃষ্টিকর্তার পরিচয় সম্পর্কে এখনো জানা যায়নি। কৌতূহলের সৃষ্টি করেছে পুরো বিষয়টি। কী উদ্দেশ্য বা কারা আকছেন এসব ছবি, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন অনেকেই।
সুবোধ সম্পর্কে যা বলছেন সাধারণ মানুষজন
সুবোধ কে এইটা এখন মুখ্য ব্যাপার নয়। অন্ধকারের বিপরীত শক্তি হচ্ছে সুবোধ। আর নির্বোধের বিপরীতে শুভবোধসম্পন্ন একটি চরিত্রকেই সুবোধ বলে তুলে ধরা হয়েছে। আর এটা হোক কোন শিল্পীর তৈরি চিত্র তাতেই বা কিছু যায় আসে না।
একজন সচ্চরিত্রবান মানুষ ও পরহিতৈষী মানুষকে সুবোধ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। আর এই সুবোধ আমাদের সুন্দর বোধগুলো, সুন্দর চিন্তাগুলো, সুন্দর স্বপ্নগুলোকে জাগিয়ে তুলার চেষ্টা করছে। প্রচলিত এই সমাজকে বদলানোর চেষ্টা করছে।
এছাড়া আজ কোনঠাসা হয়ে আছে সুবোধরা। মানুষের মনে সু-বোধের বদলে স্থান পাচ্ছে সংকীর্ণতা, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, লোভ-লালসা, হিংসা, জিঘাংসা। তাই সুবোধদের বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে সমাজ-দেশ। তাই এখন সমাজ থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইছে সুবোধ।
যেসব জায়গায় দেখা মিলছে এই সুবোধের-
মূলত মিরপুর এলাকাতেই সুবোধের গ্রাফিতিগুলো দেখা গেছে। মিরপুর থেকে শাহবাগ যাওয়ার পথে পুরান এয়ারপোর্টের দেয়ালে ( বিমান বাহিনীর সংরক্ষিত এলাকা), আগারগাঁও থেকে শ্যামলীর শিশুমেলায় যাওয়ার পথে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কাছে একটি দেয়ালে, মিরপুর সাড়ে ১১তে পূরবী সিনেমা হলের কাছে একটি বিল্ডিং-এর কাছে দেখা গেছে এই ছবিগুলো। এছাড়া রাজধানীর আরও বিভিন্ন জায়গায়ও দেখা মিলেছে এই সুবোধের। আর ‘সুবোধ’ -এর প্রায় সব দেয়ালচিত্রেই ব্যবহার হয়েছে HOBEKI?