নাটোরে উপজেলা চেয়ারম্যান বাবু হত্যার সাত বছর
নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা সানা উল্লাহ নূর বাবু বাবু হত্যার সাত বছরে ছয় তদন্ত কর্মকর্তা বদল হলেও এখনও মামলার চার্জশীট দেয়া হয়নি। গত ২০১০ সালের ৮ আক্টোবরের বহুল আলোচিত এই হত্যা মামলার সব আসামীই এখন জামিনে মুক্ত এবং তাদের মধ্যে প্রধান দু’জনই এখন নির্বাচিত জন প্রতিনিধি।
দিবসটিতে দলীয় কোন কর্মকান্ড না থাকলেও তার পরিবারের পক্ষ থেকে স্থানীয় সরদার পাড়া জামে মসজিদে দোয়া ও কোরআন খানি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ২০১০ সালের ৮ আক্টোবর শুক্রবার সকাল দশটার দিকে সাবেক মন্ত্রী বিএনপি নাটোর জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর বড়াইগ্রামের বনপাড়া বাজারে আগমন উপলক্ষ্যে মিছিল বের করে স্থানীয় বিএনপি। বাজারে রাস্তার ওপর প্রকাশ্যে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছ্ত্রালীগের বেশ কিছু চিহ্নিত নেতাকর্মীরা কুপিয়ে ও পিটিয়ে নির্মমভাবে বড়াইগ্রাম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা সানাউল্লাহ নূর বাবুকে হত্যা করে রাস্তায় ফেলে রাখে।
হত্যা নিশ্চিত করতে তারা পরে বাবুর হাত ও পায়ের রগও কেটে দেয়। এই হত্যার ছবির ভিডিও ফুটেজ ধারণ করার অপরাধে নাটোরের আরটিভির সাংবাদিক শেখ তোফাজ্জল হোসেনকেও মেরে মারাত্মকভাবে আহত করে তার ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে ফুটেজ নষ্ট করে দেয়া হয়। স্বামী সানাউল্লাহ নূর বাবু হত্যার পর তার স্ত্রী মহুয়া নূর কচি বাদী হয়ে বড়াইগ্রাম থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি আব্দুল আলিম হত্যার প্রধান আসামী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক বর্তমানে বনপাড়া পৌরসভার মেয়র কে এম জাকির হোসেনকে প্রধান আসামী করে মোট ২৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এর পরে তিনি পুলিশের কাছে আরো ১৮ জনের একটি তালিকা দিয়ে এই মামলায় তালিকাভুক্ত করার আবেদন করলে তাও গৃহীত হয়। বাবু হত্যা মামলার ৪৫ জন আসামীই এখন জামিনে মুক্ত রয়েছেন। মামলা দায়েরের পরপরই তদন্ত কর্মকর্তা ও বড়াইগ্রাম থানার ওসির কাছে থেকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব দেয়া হয় ডিবির এসআই আব্দুল হান্নানের ওপর।
তার কয়েকদিনের মধ্যে তিনি ষ্ট্যান্ড রিলিজ হলে অধিকতর তদন্তের স্বার্থে মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়। সিআইডি রাজশাহী অফিসের পরিদর্শক আহাম্মদ আলীর কাছে প্রায় চার বছর মামলাটি থাকার পরেও তিনি তদন্ত শেষ করতে পারেন নাই। প্রায় এক বছর আগে তিনি বদলী হয়ে গেলে মামলার তদন্তভার পান রাজশাহী সিআইডির পুলিশ সুপার জুলফিকার মোহাম্মদ গাজ্জালী। গত দু’মাস আগে তিনিও বদলী হয়ে গেলে মামলার তদন্তভার পেয়েছেন রাজশাহী সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার মিয়া মোঃ আশিক বিন হাসান। প্রায় এক বছর আগে পদোন্নতি পাওয়ায় তিনিও বদলী হয়ে গেলে মামলার দায়িত্ব পান সিআইডি রাজশাহীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো: সোহেল রানা।
বিএনপি নেতা সানাউল্লাহ নূর বাবু হত্যা মামলার সাত বছরে কতটা অগ্রগতি হয়েছে জানার জন্য সিআইডি রাজশাহীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো: সোহেল রানা সাথে যোগযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। মামলার বাদী বাবুর স্ত্রী মহুয়া নূর কচি জানান, বাবু নিজের জনপ্রিয়তা বুঝেই বনপাড়া পৌরসভার নির্বাচিত চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে বড়াইগ্রাম উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে অংশ নিয়ে সরকার দলীয় প্রার্থীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এর পর থেকেই সন্ত্রাসীরা তাকে মোবাইলে এবং প্রকাশ্যে দলীয় কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকার কথা বলে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল। এমনকি সর্বহারা পরিচয়েও তাকে একাধিকবার হত্যা করার হুমকি দেয়া হয়। গত ২০১০ সালের ৮ আক্টেবর দিনের বেলায় আওয়ামী লীগের লোকজন শত শত লোকের সামনে কি নির্মমভাবে বাবুকে হত্যা করে তা দেশবাসী জানেন। এই নির্মম হত্যার দৃশ্যটি সাংবাদিকদের মাধ্যমে বিভিন্ন বেসরকারী টিভি চ্যানেলে প্রচারিত এবং জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হওয়ায় তা সারা দেশ ও বিশ্ববাসী দেখেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের তৎকালিন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ভিডিও ফুটেজ দেখে তখন আসামীদের সনাক্ত করে আইনের আওতায় আনারও আশ্বাস দিয়েছিলেন। বাবু হত্যার তৃতীয় বছরে একই মাসের চার তারিখে বাবুর চাচা ও থানা যুবদলের সহ-সভাপতি আবুল বাশার মাষ্টারকে একই ভাবে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা গুলি করে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও হাত পায়ের রগ কেটে হত্যা করে। বাবু হত্যাকান্ডের পর থেকেই রাজনীতির মাঠে মহুয়া নূর কচি ছিলেন বেশ সক্রিয়। গত বছরের ২১ জানুয়ারী থেকে তিনি আইভিআইজি ভাইরাসে আক্রান্ত হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (সাবেক পিজি) ডাঃ ইকবালের তত্বাবধানে তিনি দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থেকে ব্যয় বহুল চিকিৎসা খরচ চালাতে গিয়ে পুরো পরিবারই এখন নিঃস্ব হতে চলেছে। গত বছরের ১০ জুন সানা উল্লাহ নূর বাবুর বাব স্বাস্থ্য বিভাগের রাজশাহী বিভাগীয় সাবেক পরিচালক ডা. সাবের হোসেনও খুন হন। সাবের হোসেনের প্রথম স্ত্রী সানা উল্লাহ নূর বাবুর মা ডা. সফুরা বেগমও এখন জীবনের শেষ অবস্থায়। একমাত্র ছেলে ও স্বামী হারানোর শোকে তিনিও এখন মৃত্যু পথযাত্রী। বিবাহিত জীবনে সানা উল্লাহ নূর বাবুর কোন ছেলে নেই, তিনটি মেয়ে আর তিন জনই এখনও ছাত্রী। বাবু ও তার বাবা ডা. সাবের হোসেন খুন হওয়ার পর সংসারের ভার নেয়ার মত কোন পুরুষ মানুষ না থাকায় এবং বাবুর স্ত্রী ও মা দুজনেই অসুস্থ্য হয়ে পড়ায় এখন পরিবারটি অভিভাবকহীন হয়ে পয়েছে।
মহুয়া নূর কচি আরো জানান, বছর পর বছর তদন্ত চালানোর কথা বলে তদন্ত কর্মকর্তাগন শুধু সময় ক্ষেপনই করে চলেছেন। গত সাত বছরে তাদের তদন্ত শেষ না হওয়ায় তারা আজও মামলার চার্জশীট দিতে পারেননি। তার তিন মেয়ে কবে তাদের পিতা হত্যার বিচার পাবে বা আদৌ কোনদিন পাবে কিনা তা নিয়েই পরিবারের সবাই এখন সন্ধিহান হয়ে পড়েছেন।
তানজীন মাহমুদ (তনু), নিজস্ব প্রতিনিধি