বাংলাদেশে অঙ্গ দান সহজ করতে কী করা হচ্ছে?

বাংলাদেশে ১৯৮৮ সালে প্রথমবারের মতো সফল কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছিলো। কিন্তু এর পর থেকে এত বছরে দেশে মাত্র এক হাজারের মতো কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে বছরে ৪০ হাজারের মতো মানুষের কিডনি বিকল হয়ে যায়। বাংলাদেশে অন্যান্য রোগে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে গেলে সেটি প্রতিস্থাপনের চিত্রও একই রকমই হতাশাব্যঞ্জক। এর প্রধান কারণ বলা হচ্ছে বাংলাদেশে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দান করার চিত্র খুবই করুণ।

মৃত ব্যক্তির অঙ্গ নেয়া বাংলাদেশে এখনো শুরুই হয়নি। কিন্তু এর কারণ কী? অঙ্গ দান সহজ করতে কী করা হচ্ছে?

“আমাদের দেহটা পৃথিবীতে যতদিন চলবার ততদিন চললাম, কিন্তু তারপর তো অকেজো হয়ে যাচ্ছে”-বলছিলেন প্রবীণ লেখক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সংগঠক কামাল লোহানী। তাঁর সাথে কথা হচ্ছিলো তাঁর ধানমন্ডির বাড়িতে। ২০১৪ সালে তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের সেবায় নিজের পুরো শরীর দান করেছেন। তিনি বলছিলেন কী কারণে তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

২০১৪ সালে তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের সেবায় নিজের পুরো শরীর দান করেছেন কামাল লোহানী।

“অকেজো না হয়ে আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যদি কোন কারণে অন্য কারো কাজে আসে, তাকে বাঁচাবার ক্ষেত্রে অথবা তার জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনভাবে কাজে আসে, সেই জায়গাটা থেকেই ইচ্ছেটা হচ্ছে আমাদের দেহটা দিয়ে যাচ্ছি এবং আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেখানে যা দরকার হবে সেইটাই এরা ব্যবহার করবে।”

ধানমন্ডি থেকে খুব বেশি দুরে নয় ঢাকার ভাটারা এলাকা। ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে সেখানকার বাসিন্দা মোহাম্মদ মনজুর আলম হঠাৎ আবিষ্কার করলেন তার দুটো কিডনিই ৮০ শতাংশ বিকল হয়ে গেছে। এখন বয়স ৩১ বছর। তার একমাত্র ভরসা কিডনি প্রতিস্থাপন। তা না হলে যন্ত্র ব্যবহার করে বা ডায়ালিসিস করে যতদিন বাঁচার বাঁচবেন।

মোহাম্মদ মনজুর আলমের দুটো কিডনির ৮০ শতাংশই বিকল, অঙ্গদাতা পাননি বলে ভেষজ চিকিৎসা নিয়ে চলছেন তিনি।

“মন খুবই ভাইঙ্গা যায় যে এই বয়সে আমার এরকম একটা সমস্যা হলো। আমি এই পর্যন্ত আসলাম, এত কষ্ট করে পড়ালেখা করলাম, এখন আমি কিছুই করতে পারবো না? আমার দুইটা কিডনিই শেষ? আহা কী করবো এখন”।

আত্মীয়দের কাছ থেকে কিডনি নেয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় মি: আলমের নেই। কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি। আত্মীয়দের অঙ্গ দিতে রাজি করানো তার জন্য প্রথম ঝক্কি।

‘অন্য বিকল্পগুলো ব্যয়সাপেক্ষ’ বলছিলেন তিনি। তাই এরপর থেকে চেষ্টা করেই যাচ্ছেন চিকিৎসায় সব খোয়ানো মনজুর আলম এবং শেষমেশ আরো অনেকের মতো ভেষজ চিকিৎসার শরণাপন্ন হয়েছেন।

চিকিৎসকদের কয়েকটি সমিতি থেকে জানা যাচ্ছে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪০ হাজার মানুষের কিডনি বিকল হয়ে যায়।দেশে এক কোটির বেশি মানুষ হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত। যার অন্তত ১০ শতাংশের লিভার বিকল হয়ে যায়। কর্নিয়াজনিত সমস্যার কারণে অন্ধের সংখ্যা পাঁচ লাখ। এতো গেলো নানা ধরনের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়ার অল্প কিছু খতিয়ান। কিন্তু দু:খজনক হলেও এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের খতিয়ান খুবই হতাশাব্যঞ্জক।

বছরে দেশে মোটে দেড়শোটির মতো কিডনি প্রতিস্থাপন হয়। বছরে মাত্র ৪০ থেকে ৫০ টি কর্নিয়া সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত কেবল চারটি লিভার সংযোজন হয়েছে। ফুসফুস ও হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন একেবারেই হয়নি। অস্থিমজ্জা সংযোজন কিছুটা হচ্ছে। সোসাইটি অফ অরগ্যান ট্র্যান্সপ্ল্যানটেশন বাংলাদেশের প্রধান কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হারুনুর রশিদ বলছেন, বাংলাদেশে মৃত ব্যক্তির শরীর থেকে অঙ্গ নেয়া একেবারেই হয় না। সেটি সম্ভব হলে কি হতো।

“একজন মৃত ব্যক্তি দুটো কিডনি, একটা লিভার, একটি হৃদপিণ্ড, দুটো ফুসফুস, প্যানক্রিয়াস, ইন্টেস্টাইন দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে একজন মৃত ব্যক্তি অন্তত পাঁচজন অর্গান ফেইলিওর হওয়া মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন। ক্যাডাভারিক ট্রান্সপ্লানটেশনের দিকে আমাদের যেতেই হবে। কারণ রোগী তো অনেক বেশি। তা না হলে অর্গান আমরা পাবো না। আমাদের সামনে অনেক দূর যেতে হবে”।

বিশ্বের সর্বত্রই মৃত ব্যক্তির কাছ থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করা বা ক্যাডাভারিক ট্রান্সপ্লান্টেশনের উপরে চিকিৎসা বিজ্ঞান বেশি নির্ভরশীল। কিন্তু বাংলাদেশে আত্মীয়দের কাছ থেকে অল্প কিছু কিডনি পাওয়া গেলেও সব মিলিয়ে অঙ্গদানে রয়েছে ব্যাপক অনীহা। বাংলাদেশে নানা রোগে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে গেলে সেটি প্রতিস্থাপনের চিত্র এমন হতাশাব্যাঞ্জক হওয়ার কারণ কি? বাংলাদেশ লিভার ফাউন্ডেশনের মহাসচিব অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলছেন বাংলাদেশে কুসংস্কার ও ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা এর অন্যতম প্রধান কারণ।

“অনেকে রিলিজিয়াস একটা গ্রাউন্ড দাড় করান যে আমি মরে গেলাম, আমার লিভার খুলে নিলো, আমার হার্ট খুলে নিলো, কি নিয়ে আমি কবরে যাবো। আমরা জনগণকে বুঝাই যে ধর্মে কোন বারণ নাই কারণ সৌদি আরবের মতো জায়গায় লিভার ট্রান্সপ্লান্ট, হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট সবই হচ্ছে। ধর্মও্র এমন বলে না যে তুমি মরার পরে অঙ্গ দান করতে পারবা না”

বাংলাদেশে আত্মীয়দের কাছ থেকে অল্প কিছু কিডনি পাওয়া গেলেও সব মিলিয়ে অঙ্গদানে রয়েছে ব্যাপক অনীহা।

অধ্যাপক আলী বলছেন বাংলাদেশে প্রতিস্থাপনের সুবিধাও খুব কম। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত সবচেয়ে সফলভাবে যে অঙ্গ প্রতিস্থাপন হচ্ছে সেটি হলো চোখের কর্নিয়া। সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি বলছে ১৯৮৪ সালে তাদের চক্ষু সংগ্রহের কাজ শুরুর পর থেকে ৩৬ হাজার ব্যক্তির অঙ্গীকার পেয়েছেন তারা।

সংস্থাটির সাধারণ সম্পাদক ডা মোহাম্মদ জয়নাল আবদিন অবশ্য বলছেন অঙ্গীকার দাতাদের মৃত্যুর পর তাদের আত্মীয়রা প্রায়ই তাদের কোনো খবর দেন না। মৃত ব্যক্তিদের নিয়ে আত্মীয়দের আবেগও তাদের জন্য একটি বড় বাধা।

“এমনও হয়েছে যে চক্ষু দান করেছেন কিন্তু তাদের আত্মীয়রা আমাদের খবর দেননি। সেক্ষেত্রে আমরা সেই কর্নিয়া আমাদের পক্ষে পাওয়া সম্ভব না। আমরা একটা ইমোশনাল জাতি।

একটা মানুষ মারা যাওয়ার পর আমরা যখন শোকাতুর পরিবারে কর্নিয়া গ্রহণ করার জন্য যাই তখন ওখানে আরো যে মানুষগুলো আছে তাদের অন্যভাবে মোটিভেট করে যে আমরা এরকম সময় এই কাজটা কেন করি। কিন্তু আসলে এখানে শোকের ঊর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর মানবতার কথা আমাদের ভাবা উচিত”

কিন্তু সেটি হয়তো সবসময় সহজ নয়। তাই পরিবারের সদস্যদের বোঝানোর ব্যাপারে মত দিচ্ছেন তিনি। কিন্তু বাংলাদেশে একই সাথে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের আইনি জটিলতাও রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দান সহজ করতে এ সম্পর্কিত অবৈধ কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে একটি আইন সংশোধনের চেষ্টা করছে সরকার। সেটি সংসদে গৃহীত হলে রক্তের সম্পর্ক রয়েছে এমন অনেক বেশি সংখ্যক নিকটাত্মীয়র কাছ থেকে অঙ্গ নেয়া যাবে। মৃত ব্যক্তির অঙ্গ সংগ্রহও আগের থেকে সহজ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। সে সম্পর্কে বলছিলেন বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম।

“এই আইন আমরা যুগোযোগী করেছি এই কারণে যে আত্মীয়র সংজ্ঞা, কে দিতে পারবে বা কে পারবে না সে নিয়ে অস্পষ্টতা ছিলো। তাতে অনেক সময় দেখা গেছে অস্পষ্টতা থাকার কারণে আমাদের ডাক্তাররা অনেক সময় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কাছে নিগৃহীত হয়েছেন। অনেক হাসপাতাল তাই এব্যাপারে উদ্যোগ নিতো না। সেজন্য এটি সুস্পষ্ট করা হয়েছে” বলছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

অর্থাৎ এই আইন পাশ হলে শুধু বাবা মা বা ভাই বোন নন, রক্তের সম্পর্ক আছে এমন নিকটাত্মীয়, নানা-নানী, দাদা-দাদী এমনকি চাচাতো খালাতো ভাইবোনও অঙ্গ দিতে পারবেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন এতে সংখ্যা বাড়বে। আইনে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অবৈধ বেচা-কেনার ব্যবসা বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নিকট আত্মীয় সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিলে বা অন্যান্য বিধান লঙ্ঘন করলে শাস্তির প্রস্তাব করা হয়েছে। চিকিৎসকেরা অনেক সময় কঠোর আইনের কারণে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন বলে উল্লেখ করেছেন। স বমিলিয়ে এই মুহূর্তে বাংলাদেশে কোনো অসুখে শরীরের কোনো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে গেলে বেশিরভাগের মানুষই নিয়তি মেনে নিয়ে সম্ভবত মৃত্যুর অপেক্ষা করেন। প্রচুর অর্থের যোগান দেয়া সম্ভব হলেই কেবলমাত্র এর ব্যত্যয় সম্ভব।