জীবনের তাগিদে সুন্দরবনের জলদস্যুদের আত্মসমর্পণ

বাগেরহাট শহরের এই এলাকাটা আর পাঁচটা মফস্বল শহরের মতোই। গাছগাছালিতে শ্যামল সবুজ। কোলাহল থেকে দূরে, নীরব, নিঝুম জনপদ। শুধু মাঝে মাঝে এই নিস্তব্ধতার বুক চিরে শোনা যায় মোটরসাইকেল ইঞ্জিনের আওয়াজ। এখানেই মোস্তফা শেখের মোটরসাইকেল সারাইয়ের দোকান।

এক দুপুরে মোস্তফা শেখের গ্যারেজে গিয়ে দেখা গেল আর পাঁচটা গ্যারেজের মতোই তা সাধারণ। দুজন কর্মচারি, থাকে সাজানো স্পেয়ার পার্টস, কম্প্রেসরের শব্দ, লুব্রিকেন্ট আর পোড়া তেলের গন্ধ। এলাকার লোকজন মোস্তফা শেখকে চেনে এই গ্যারেজের মালিক হিসেবে। কিন্তু তার আসল পরিচয় শুনলে অনেকেই চমকে যাবেন। কারণ এই মোস্তফা শেখই ছিলেন সুন্দরবনের দুর্ধর্ষ জলদস্যু দল মাস্টার বাহিনীর প্রধান কাদের মাস্টার।

মাস্টার বাহিনীর প্রধান কাদের মাস্টার ( আসল নাম মোস্তফা শেখ), আত্মসমর্পণের আগে।

“আমাদের এখনকার জীবন তো বোনাস পাওয়া জীবন। আমাদের তো বেঁচে থাকারই কথা ছিল না। সরকার, র‍্যাব, মিডিয়া – এদের জন্যেই আমরা এখন সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে পেরেছি,” বলছিলেন মোস্তফা শেখ, “আমার স্ত্রী, আমার মেয়ে, পরিবার – এদের সাথে থাকতে পারছি। সৎ পথে দুটো পয়সা রোজগার করে দু’মুঠো খেতে পারছি। আমার কাছে এর চেয়ে বড় শান্তি আর কিছু নেই।”

জলদস্যু জীবনের অনেকটাই কাটে নৌকার ওপর।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে সুন্দরবনে কয়েক দশক ধরে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে যেসব জলদস্যু দল, সরকারের এক বিশেষ ক্ষমার আওতায় তারা এখন দলে দলে আত্মসমর্পণ করছে। ফিরে আসছে স্বাভাবিক জীবনে। নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, এর ফলে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ফরে আসছে শান্তি। এই ম্যানগ্রোভ অরণ্যে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যেসব জেলে, মৌয়াল, কাঁকড়া শিকারি – তারা এখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে শুরু করেছেন। বনের কাঠ চুরি কম হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন বন কর্মকর্তারা। আর জলদস্যুদের সহায়তায় অবৈধ শিকার কমে যাওয়ায় প্রাণে রক্ষা পাচ্ছে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। শুধু সুন্দরবনের অরণ্যই না, পূবে কক্সবাজার থেকে শুরু করে পশ্চিমে পাথরঘাটা, মংলা – এই বিস্তীর্ণ উপকূল জুড়ে জলদস্যুরা একসময় জেলেদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করতো, জেলেদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করতো, ট্রলার আটক করে অর্থ দাবি করতো – সেই সব কর্মকাণ্ড এখন থেমে গিয়েছে বলে জানাচ্ছেন স্থানীয় লোকজন।

মোস্তফা শেখের গ্যারেজ থেকে একটু দূরেই তার বাসা। সেখানে থাকেন তার স্ত্রী, মা আর তার একমাত্র কন্যা। দেখে টের পাওয়া যায় সংসারে অর্থের বৈভব নেই। কিন্তু স্বস্তি আছে। কথা হলো মোস্তফা শেখের স্ত্রী হাসি বেগমের সাথে। তিনি বলছিলেন, স্বামীর পেশার কারণে পাড়াপ্রতিবেশিদের কাছ থেকে বহুদিন তাকে নানা ধরনের গঞ্জনা সইতে হয়েছে। নিকট আত্মীয় স্বজনেরা দূরে দূরে থেকেছে।

“প্রতিবেশীরা নানা প্রশ্ন করতো। জিজ্ঞেস করতো স্বামী আসে না কেন। আমি বলতাম ব্যবসা করে তো, তাই তাকে বাইরে বাইরে থাকতে হয়”, বলছিলেন হাসি বেগম, “আমার মেয়ে, মার্জিয়া, প্রশ্ন করতো সবার আব্বু সাথে থাকে, আমার আব্বু আমাদের সাথে থাকে না কেন? আমি জবাব দিতে পারতাম না।‍”

জলদস্যুদের আত্মসমর্পণের পর বদলে গেছে এই পরিবারগুলোর জীবনধারা। কিন্তু কোন কারণে সরকারের মনোভাবে যদি পরিবর্তন ঘটে, তাহলে তাদের কী হবে? এই প্রশ্ন নিয়ে তারা এখনই দুশ্চিন্তা করতে রাজি না। তারা তাদের নিকটজনকে কাছে পেয়েই খুশি। মোস্তফা শেখের বাড়িতেই কথা হলো ফজলু শেখ, শাহিন শেখ, মো. আরিফ বিল্লাল আর মোঃ. হারুনের সঙ্গে। এরা সবাই একসময় মাস্টার বাহিনীর দুর্ধর্ষ সদস্য ছিলেন। আত্মসমর্পণের পর এরা এখন বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকেন। কথায় কথায় তারা জানালেন, জঙ্গলের জীবন ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। লোকালয়ে র‍্যাব, পুলিশ, আর সাধারণ মানুষ — যাদের হাতে ধরা পড়লে রেহাই নেই। অন্যদিকে, বনে আছে বাঘ, সাপ আর প্রতিদ্বন্দ্বী জলদস্যু দল, যাদের খপ্পরে পড়লেও নিশ্চিত মৃত্যু।

“বনের মধ্যে বাঁচতে হলে হরিণের চেয়েও সতর্ক থাকতে হয়,” বলছিলেন ফজলু শেখ, “মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রতিদিন তৈরি হতে হয়। প্রতিদিন নিজেকে বলতে হয় আজকেই বোধ হয় শেষ দিন।”

আত্মসমর্পণ করেছেন এমন প্রায় সব জলদস্যুর জীবনই একেকটি গল্পের মত। দু’একজন স্বীকার করেছেন, রোমাঞ্চের জন্যই তারা দস্যুদলে নাম লিখিয়েছিলেন। কিন্তু বেশিরভাগ জলদস্যুর দাবি, তারা ইচ্ছে করে এই পথে আসেননি। পরিস্থিতির চাপে এই পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন।

“আমি তো জন্মগতভাবে ডাকাত ছিলাম না। পাড়া-প্রতিবেশী, গ্রামের ক্ষমতাবান মানুষ আমাকে এই পথে ঠেলে দিয়েছে,” বলছিলেন মোঃ হারুন।

কিন্তু বাস্তবতা হলে এসব ঝুঁকি মাথায় নিয়েই মাস্টার বাহিনীর এসব সদস্য দীর্ঘদিন ধরে জলদস্যুতার সাথে যুক্ত ছিলেন। এর পেছনে তাদের মূল আকর্ষণ ছিল লক্ষ লক্ষ টাকা। মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই সুন্দরবন ক্রমশই সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চেলে যেতে শুরু করে। উনশিশো আশির দশকে গনি বাহিনীর হাতে সংগঠিত দস্যুতার সূচনা হলেও পরবর্তী এক দশকের মধ্যে প্রায় ডজন-খানেক জলদস্যু দল ভাগাভাগি করে পুরো অরণ্য এবং তার নিকটবর্তী উপকূল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। জলদস্যুদের উপদ্রবে ঐ অঞ্চলের মানুষের জীবনে যখন নাভিশ্বাস উঠছে তখন সরকার কিছুটা বাধ্য হয়েই একটি টাস্কফোর্স গঠন করে। জলদস্যু দমনের বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয় এই টাস্কফোর্সকে। র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) এই টাস্কফোর্সে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

র‍্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ সম্প্রতি এক নিবন্ধে লিখেছেন, “১৯৮০’র দশক থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শতাধিক জলদস্যু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গ সরাসরি সরাসরি বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছে।”

“এদের মধ্যে শীর্ষ বাহিনীর প্রধান শীর্ষ, ফেরাউন বাহিনীর প্রধান বেল্লাল, কাসেম বাহিনীর প্রধান কাসেম উল্লেখযোগ্য।”

কিন্তু টাস্কফোর্সের অভিযানের মুখে জলদস্যুদের আয় এবং তাদের তৎপরতার জায়গা ক্রমশ সংকুচিত হয়ে এলেও এদের পুরোপুরিভাবে দমন করা সম্ভব হয়নি। কারণ জলদস্যুতার চক্রটি শুধু জঙ্গলের ভেতরেই কাজে করে না। জঙ্গলের বাইরে – লোকালয়েও এই চক্রের একটি অংশ পর্দার পেছনে থেকে কাজ করতে থাকে। ফলে সময়ে সময়ে জলদস্যু নিহত হওয়ার খবর জানা গেলেও আত্মসমর্পণের খবর পাওয়া যায় কদাচিৎ। কিন্তু এই স্ট্যাটাস-কো বা স্থিতাবস্থার এক নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে ২০০৯ সালে। আর সেটা কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে ঘটেনি। সেটা ঘটেছিল একজন সাংবাদিকের হাতে। মূলত তারই উদ্যোগে শুরু হয় জলদস্যুদের আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া। (এ সম্পর্কে আলাদা প্রতিবেদন আসছে।)

যমুনা টেলিভিশনের বর্তমান বিশেষ প্রতিবেদক মোহসীন-উল হাকিম তখন কাজ করতেন দেশ টিভিতে। দুহাজার নয় সালের নভেম্বর মাসে ঘূর্ণিঝড় আইলা ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলাদেশের উপকূলের ওপর। লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সুন্দরবন অঞ্চল। আইলা সংবাদ সংগ্রহ করতে সুন্দরবন অঞ্চলে গেলে গ্রামের লোকজন তাকে বলেন, ঝড়ের ক্ষতির চেয়েও বড় ক্ষতি তাদের ঘটছে জলদস্যুদের হাতে।

কথাটি তাকে এতটাই নাড়া দিয়েছিল যে সমস্যাটি নিয়ে তিনি ভাবতে শুরু করেন। ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো তিনি যোগাযোগ করেন মোতালেব বাহিনী দলনেতা মোতালেবের সাথে। তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আত্মসমর্পণে রাজি করানোই ছিল লক্ষ্য। কিন্তু তাতে খুব একটা সফল হননি তিনি। কিন্তু দমে না গিয়ে কথাবার্তা চালিয়ে যান অন্য গ্রুপগুলোর সাথে।

“জলদস্যুদের বিরুদ্ধে টাস্কফোর্সের অভিযানের মাঝেই ২০১৫ সালে মাস্টার বাহিনী প্রধান কাদের মাস্টারের সাথে আলোচনা শুরু করি,” বলছিলেন মি. হাকিম, “তার সাথে কথা বলে বুঝতে পারি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ব্যাপারে তাদের মধ্যে প্রচণ্ড একটা আগ্রহ কাজ করছিল। কিন্তু তারা কোন পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। আমার মনে হলো যোগাযোগের এই শূন্যতা পূরণ করা সম্ভব।”

এরপর মহসীন-উল হাকিম, র‍্যাব-৮ এর উপ-অধিনায়ক মেজর আদনান কবীর এবং সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে আলোচনার পথ ধরে আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হয়।

প্রথম জলদস্যুদল মাস্টার বাহিনীর প্রধান কাদের মাস্টার ২০১৬ সালের ৩১শে মে সুন্দরবন থেকে বেরিয়ে আসেন মহসীন-উল হাকিমের সঙ্গে । তার সাথে ছিল নয় জন অনুচর, ৫২টি অস্ত্র ও পাঁচ হাজার রাউন্ডেরও বেশি গুলি। পরে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সমর্পণ করে।

“মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট কেস,” স্মরণ করলেন মি. হাকিম। কারণ র‍্যাবের সঙ্গে আলোচনা এবং এই আত্মসমর্পণের পরিণতি কী হয় তা অন্যান্য গ্রুপগুলো সতর্কতার সাথে লক্ষ্য করছিল। তাদের মনে একটা ভয় কাজ করছিল যে আত্মসমর্পণের পর তাদের মেরে ফেলা হবে।

“কিন্তু সেটা যখন ঘটলো না। যখন বোঝা গেল সরকার সত্যিই আন্তরিকভাবে জলদস্যু সমস্যার সমাধান চাইছে, তখন অন্যান্য দলগুলো নিজেরাই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করলো।”

এরপর একে একে আত্মসমর্পণ করে আরও ১১টি দলের সদস্য ১৫০ জন জলদস্যু। র‍্যাবের কাছে জমা পড়ে বিভিন্ন ধরনের প্রায় ২৪৭টি আগ্নেয়াস্ত্র।

র‍্যাব মহাপরিচালকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দু’তিনটি বাহিনী এখনও সুন্দরবনে সক্রিয় রয়েছে। আত্মসমর্পণ কিংবা র‍্যাবের অভিযানের মাধ্যমে এই দলগুলোও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বলে তিনি মনে করছেন।