নব্য জেএমবির হামলার নতুন লক্ষ্য জনবহুল স্থান

নব্য জেএমবি তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু পরিবর্তন করেছে। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও বিদেশি নাগরিকদের পর এখন তাদের লক্ষ্যবস্তু জনবহুল স্থান, যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এক যুগ আগে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ৬৩ জেলায় একযোগে ৫০০ বোমা ফাটিয়ে নিজেদের জানান দিয়েছিল জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। এই জেএমবি থেকেই জন্ম নেয় নব্য জেএমবি। নৃশংসতা ও আত্মঘাতী হামলার তৎপরতার কারণে তারা এখন দেশের সবচেয়ে ভয়ংকর জঙ্গিগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। যারা আইএসের মতাদর্শ অনুসরণ করে। নব্য জেএমবির পাশাপাশি পৃথক নেতৃত্বে সক্রিয় রয়েছে পুরানো ধারার জেএমবিও।

জঙ্গিবাদ দমনে যুক্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নব্য জেএমবি আরেকটা বড় হামলা চালানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। তার অংশ হিসেবে গত সোমবার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের আশপাশে শোক দিবসের র‍্যালিতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতিসাধনের পরিকল্পনা করে তারা। ১৭ আগস্টের দুই দিন আগে ১৫ আগস্টের জনসমাগমকে লক্ষ্য করে হামলার পরিকল্পনা তার প্রমাণ। এর আগে জুলাই মাসের শুরুতে ঢাকার অদূরে ধামরাইয়ে উল্টোরথযাত্রায় জঙ্গি হামলার পরিকল্পনার সুনির্দিষ্ট তথ্য পায় বলে দাবি করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যার কারণে রথযাত্রা উপলক্ষে আয়োজিত মেলা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

টানা অভিযান এবং অনেকগুলো জঙ্গি আস্তানা ধ্বংস এবং শীর্ষ নেতাসহ বেশ কয়েকজন জঙ্গি নিহত হওয়ার পর নব্য জেএমবি এত দ্রুত নতুন করে হামলা করতে নামবে, তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধারণার বাইরে ছিল। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সংখ্যায় অনেক বেশি না হলেও নাশকতা চালানোর মতো আত্মঘাতী জঙ্গি নব্য জেএমবির হাতে রয়েছে। তাদের সদস্য সংগ্রহও অব্যাহত আছে। তিনি বলেন, জঙ্গিরা আগের মতো বাসা ভাড়া করতে পারছে না। তাই কোনো জঙ্গি আস্তানায় নয়, নিজের বাড়ি থেকেই একজন জঙ্গি সদস্য নাশকতার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে। সরাসরি বাড়ি থেকে এসে আক্রমণে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক একাধিক ঘটনায় এই প্রবণতা লক্ষ করা গেছে।

২০১৫ সালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে সালাহউদ্দিন ওরফে সালেহীন, মিজানুর রহমান ওরফে বোমা মিজান ও হাফেজ মাহমুদকে ছিনিয়ে নেয় পুরানো জেএমবি। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হাফেজ মাহমুদ ধরা পড়ে এবং বন্দুকযুদ্ধে নিহত হলেও বাকি দুজনকে এখন পর্যন্ত ধরতে পারেনি পুলিশ।

অবশ্য সীমান্তের ওপারে ভারতে জেএমবির তৎপরতা অনেক আগে থেকেই ছিল। ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী বোমা হামলার আগেই ভারতের মুর্শিদাবাদের মালদহে জেএমবির একটি শাখা ছিল। শায়খ আবদুর রহমান গ্রেপ্তারের পর টিএফআই সেলে যে জবানবন্দি দেন, তাতে এ বিষয়ে তথ্য দেন তিনি।

এরপর ২০১০ সালে গ্রেপ্তারের পর জেএমবির বর্তমান আমির সাইদুর রহমানও পুলিশকে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, ভারতে জেএমবির ১০০ এহসার (সার্বক্ষণিক সদস্য) ও ২০ হাজার সমর্থক রয়েছে। ভারতের নদীয়া, মালদহ, মুর্শিদাবাদে সাতটি মাদ্রাসা আছে; যেগুলো জেএমবির অনুসারীদের দ্বারা পরিচালিত।

জেএমবির বিষয়ে ওয়াকিবহাল একটি সূত্র জানায়, দেশে জেএমবিকে পরিচালনার জন্য সালাহউদ্দিন একজনকে সমন্বয়কারী নিয়োগ দিয়েছে। তার নাম খোরশেদ আলম ওরফে জিয়া। বাড়ি জামালপুরের সরিষাবাড়ী। সে বাড্ডায় খিজির খান হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী বলে মামলার অভিযোগপত্রে এসেছে। খোরশেদ জেএমবির অনেক পুরোনো সদস্য। ২০০৩ সালে জয়পুরহাটের ক্ষেতলালে পুলিশের ওপর হামলা মামলারও পলাতক আসামি সে।

কারাবন্দী জেএমবির নেতাদের জামিনে বের করা, মামলা পরিচালনার কাজ দীর্ঘদিন ধরে সংগঠনের পক্ষে দেখাশোনা করছে এই খোরশেদ। গত বছর বেশ কয়েকজন জেএমবি সদস্য সাজা শেষে বা জামিনে বেরিয়েছে বলে পুলিশ ও কারাগার সূত্রে জানা গেছে। এর আগে জেএমবির সমন্বয়কারী ছিল আবদুল্লাহ আল তাসনিম ওরফে নাহিদ। সে ২০১৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর আশুলিয়া থেকে গ্রেপ্তার হওয়ার পর খোরশেদ দায়িত্ব পায়। পুরোনো জেএমবির একাধিক অর্থদাতাও রয়েছে, যারা তৈরি পোশাক কারখানার মালিক। এমন দুজন এখন কারাগারে আছে।

কিছুদিন আগে জামিনে বেরিয়ে আসা জেএমবির পুরোনো এক সদস্যের বরাত দিয়ে একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জেএমবি নতুন সদস্য সংগ্রহের চেষ্টার পাশাপাশি নিষ্ক্রিয় সদস্যদের উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে নব্য জেএমবি থেকেও কয়েকজন পুরোনো জেএমবিতে ফিরে এসেছে বলে ওই সূত্র জানায়।

প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগ দিয়ে কুমিল্লায় খালেদা জিয়ার সমাবেশে বোমা হামলার চেষ্টা করা হয়। ২০১০ সালে জেএমবির আমির সাইদুর রহমান গ্রেপ্তারের পর যে জবানবন্দি দেন, তাতে তিনি বলেছিলেন, ওই সময় নির্বাচন ভন্ডুল করার জন্য বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে হামলার পরিকল্পনাও ছিল। কিন্তু খালেদার সমাবেশে হামলা করতে গিয়ে কয়েকজন ধরা পড়ায় পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়।

এরপর জেএমবি নিজেদের নতুন উপস্থিতির জানান দিতে ২০১৪ সালের শেষ দিকে দেশে বড় নাশকতা ঘটানোর পরিকল্পনা করছিল। কিন্তু তার আগে ওই বছরের ২ অক্টোবর ভারতের বর্ধমানের একটি আস্তানায় বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণের কারণে ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। তারপর ভারতে জেএমবির অনেকে গ্রেপ্তার হওয়ায় তাদের পরিকল্পনার খবর জানাজানি হয়।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, পুলিশ যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত আছে। ১৭ আগস্ট বোমা হামলার ১২ বছর উপলক্ষে জঙ্গি তৎপরতায় বিষয়ে গত সোমবার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। মনিরুল ইসলাম দাবি করেন, জঙ্গি সংগঠনগুলো খণ্ডবিখণ্ড হয়ে পড়েছে। পুলিশি অভিযানে তাদের সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে জঙ্গি সংগঠনগুলো যে ‘অপ-আদর্শ’ অনুসরণ করে, তা নির্মূলে অভিভাবক ও শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে।